তারে কয় প্রেম

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে প্রেম শব্দটির ডজনখানেকের বেশি অর্থ দেয়া আছে। সেগুলো যথাক্রমে- প্রিয়ভাব, সৌহার্দ্দ, স্নেহ, ভালবাসা, ভ্রাতৃবাৎসল্য, যুবক-যুবতীর ধ্বংসরহিত ভাববন্ধন, অনুরাগ, প্রণয়, বিয়োগাসহিষ্ণুতা (বিয়োগ+অসহিষ্ণুতা), হর্ষ, নর্ম্ম, কৃষ্ণের ইন্দ্রিয়প্রীতির ইচ্ছা, গাঢ় রতি বা অনুরাগ।

শব্দটির ব্যুৎপত্তি নির্দেশ করা আছে- প্রিয়+ইমন্। অর্থাৎ প্রিয়ভাব। প্রিয় শব্দটি আবার তৈরী হয়েছে প্রী ধাতু অ প্রত্যয় যোগে (√প্রী+অ)। প্রী ধাতুর অর্থ দেয়া আছে প্রীতি বা প্রীতিভাব। প্রিয় শব্দটির আবার গোটা আষ্টেক মানে। প্রীণয়িতা, অভীষ্ট, দয়িত, বল্লভ, অভিমত, প্রীতিকর, সহজপ্রীতিমান্, অনুরাগী প্রভৃতি।

এখন শব্দটিকে কলিম খান নির্দেশিত বর্ণভিত্তিক-ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে ফেলা যাক। মূল ধাতুটি প্রী। অর্থাৎ, প্+র্+ঈ। প্ = পালন-পান-প্রাপণ, র্ = রহন-ভক্ষণ-রক্ষণ ও ঈ = সক্রিয়। পালন রহন/রক্ষণ সক্রিয়। এর সাথে আছে অ প্রত্যয়। অ = অস্তিত্বন। সাকুল্যে প্রিয় (√প্রী+অ) কথাটির মানে দাঁড়ায় যে অস্তিত্বে পালন সক্রিয় থাকে (রহন=থাকা)। আবার আমরা এও বলতে পারি পালন-রক্ষণ (পালন করা ও রক্ষা করা) উভয়ই সক্রিয় যে অস্তিত্বে তাই ‘প্রিয়’। এবার আসি ইমন্ প্রত্যয়ে। ই+ম্+অ+ন্। ই = সক্রিয়ন, ম্ = সীমায়ন। আর অন্ দ্বারা চলিষ্ণু ঘটনার নাম ব‌োঝায়। চলন, বলন, কথন ইত্যাদি। কেন এমন হয়? কলিম খানের মতটি হলো, অ = অস্তিত্বন ও ন্ = নাকরণ-অনকরণ। অনবচ্ছিন্ন অস্তিত্বের নেতিকরণ করেলই তাকে গতিলশীল করা হয়। যেমন ধরা যাক, একটা ফুটবল। দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। নড়ছে-চড়ছে না। দিলাম এক লাথি। ধাঁ বেগে ছুটে গেল। যখন সে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন ছিল একটি অনবচ্ছিন্ন সাম্যের মধ্যে। মহাবিজ্ঞানী নিউটন একে বললেন জড়তা। বলপ্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির ও চলমান বস্তু চলমান থাকবে। সেই সাম্যভঙ্গ হলেই বলটি চলিষ্ণু হলো। তখন তার নড়ন(নড়্-অন্)-চড়ন(চড়্-অন) ঘটে। অতএব, ইমন্ হলো কোনো আধারে (সীমায়) ক্রিয়ার সক্রিয় ভাব। তাই প্রেম প্রিয়তার একটি বন্ধন বা আধার। এমনই বন্ধন যা পালন-রক্ষণে সক্রিয় থাকে। তা সক্রিয় থাকে নিরন্তর ‘অন্’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ অজস্র নেতির নেতিকরণের মধ্য দিয়েই প্রেম টিকে থাকে।

এখন, দেখতে হবে প্রেম শব্দটি যতক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, সর্বত্র এই সূত্র মেনে চলে কিনা। কবিগুরু বলেছেন, ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে’। যথার্থ কথা। দুনিয়াতে প্রেমের রূপ ও বৈচিত্র্যের অন্ত নেই। মরমী কবি বিজয় সরকার যেমন ঈশ্বর বিষয়ে বলেন, ‘বহুনামে ধরাধামে কত রঙ্গ যে দেখি!’ তেমনই বিচিত্র রঙ্গে লীলাময় প্রেম। নর-নারীর প্রেম, দেশপ্রেম, পরকীয়া প্রেম, কৃষ্ণপ্রেম, বন্ধুপ্রেম, বাৎসল্যপ্রেম, বইপ্রেম, ক্রীড়াপ্রেম, পশুপ্রেম, বৃক্ষপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম; যেদিকে তাকাই শুধু প্রেম আর প্রেম। দেখা দরকার, আমরা ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে যে শব্দার্থ নিষ্কাশন করেছি তা এই সকল প্রেমের ক্ষেত্রে ন্যূনতম শর্ত হিসেবে কাজ করে কিনা। আমি প্রয়োগ করে দেখেছি কাজ করে। সকল প্রেমের তত্ত্বতালাশ এ স্থলে বাঞ্ছনীয় নয়। অতএব হাঁড়ির দু একটি ভাত টিপে দেখা যাক।

ধরা যাক, দেশপ্রেম। ‘দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না’, বলেন রবীন্দ্রনাথ (এই হয়েছে এক জ্বালা। এই বুড়োকে বাদ দিকে কিছুই গুছিয়ে বলবার জো নেই!)। দেশপ্রেমের প্রশ্ন আসলেই তাকে রক্ষা করার প্রশ্ন আসে। দেশে সকল শুভ সম্ভাবনাকে পালন করে বিকশিত করার প্রশ্ন আসে। তা করতে গিয়ে অসংখ্য নেতির সাথে লড়াই করা প্রশ্ন আসে। অতএব পালন-রক্ষণার্থ নেতির বা অশুভের বা বাধা-বিপত্তির সাথে লড়াই দেশপ্রেমের একটি শর্ত।

আবার ধরুন আপনি বইপ্রেমী লোক। আপনাকে বইয়ের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তা করতে হবে পোকামাকড়, আর্দ্রতা ইত্যদির সাথে লড়াই করেই। কিম্বা আপনি বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। আজ যে মহীরুহ চারা তাকে ছাগলে যাতে না মুড়োয় সেই ব্যবস্থাটি করাই তো আপনার প্রেমের প্রকাশ। অথবা, বন্ধুপ্রেমের কথাই ধরুন। বন্ধু বিপদে পড়লে আপনি নিশ্চয়ই তাকে রক্ষা করেন। ছাত্রাবস্থায় দরিদ্র প্রিয় বন্ধুটির পালনের ভারও নিয়েছেন নিশ্চয়ই। ঝগড়া-বিবাদ, মান-অভিমান নিশ্চয়ই হয়েছে। সেগুলোর নেতিকরণ অর্থাৎ সমাধান করেই বন্ধুত্ব অগ্রসর হয়েছে।

ভাতে উতোল এসে গেলো। আরেকটি চাল পরীক্ষা করি এবার। যুবক-যুবতীর ধ্বংসরহিত ভাববন্ধন। নরনারীর এমন প্রেম খুঁজে পাওয়া বিরল যা কিনা অসংখ্য প্রকার বাধাবিপত্তি মোকাবেলা করে অগ্রসর হয় নি (দু-একটি নিপাতনে সিদ্ধ ব্যতিক্রম থাকতে পারে)। কত না কাব্যকাহিনি, উপন্যাস, নাটক নির্মিত হয়েছে কেবল নরনারীর প্রেম নিয়ে। লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট, রাধা-কৃষ্ণ আরো কত! কখনো প্রেমিকা সংকল্পবদ্ধ- ভয়বাধা সব অভয়মূর্তি ধরি পন্থ দেখায়ব মোর। কখনো লাইলির খোঁজে মজনু পাগলপারা। মরুপথে ক্যারাভান থেকে ক্যারাভানে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার জান-ই-মন-এর দিশা। অথবা জুলিয়েটের আর্তি - “O Romeo, Romeo, wherefore art thou Romeo? Deny thy father and refuse thy name…”। সব প্রেমিকযুগলই পালন করে কিছু সংকল্প, স্বপ্ন ও আকাঙ্খা। পরস্পরকে রক্ষা করতে চায়, এমনকি জীবনের বিনিময়ে। সে সব আমরা সিনেমাতেও দেখি হামেশাই। আক্রান্ত নায়িকাকে রক্ষা করছে নায়ক অথবা নায়িকা দরিদ্র নায়ককে রক্ষা করছে তার দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্ষমতাবান পিতা ‘চৌধুরী সাহেবের’ রোষ থেকে।

অতএব, এ পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে দেশপ্রেমই হোক আর লাইলি-মজনুর প্রেমই হোক, প্রেম হতে হলে বা প্রেম করতে হলে দুটো শর্ত মানতে হবে। এক, সম্পর্কটির আধারে বহুবিধ বিষয় পালন ও রক্ষণ করতে হবে। দুই, তা করতে গিয়ে বহু রকমের নেতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। নইলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে উপরিভাসা কিছু একটা হবে বটে, কিন্তু তা বাংলা ব্যুৎপত্তি সিদ্ধার্থ প্রেম হবে না।

অন্য ছবিও আঁকো!

এঁকো না কখনো স্বদেশের মুখ
তোবড়ানো গাল ভেঙে যাওয়া বুক
মরোমরো তার পরানভোমরা
বসে আঁকো, বসে আঁকো!
–কবীর সুমন

ক্ষুধার যে একটি যন্ত্রণা আছে এবং তা সে যন্ত্রণা যে সর্বসুখযন্ত্রণহর; তা প্রতি বক্‌ৎ-এ যারা পেটপুরে চর্ব্যচোষ্য খেয়ে বড় হয়েছেন তারা ঠিক বুঝতে পারবেন না। ক্ষুধা ও খাবার বিষয়ক আলোচনা তাই তাদের কাছে নিতান্তই হীন ও আতরাফ জাতের মনে হবে তাতে আশ্চর্য কী! কিন্তু আমি জন্ম নিয়েছি ও বেড়ে উঠেছি ক্ষুধার রাজ্যে। নিজে সে যন্ত্রণা খুব প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করার সুযোগ না হলেও ক্ষুধা নামক প্রবৃত্তি যে মানুষের আছে এবং তার নিবৃত্তি যে অনিবার্য একটি প্রয়োজন; তা বিলক্ষণ উপলব্ধি করেছি। আমি অতএব, ক্ষুধা নিবৃত্তির পথে অশনি সংকেত পেলে যারপরনাই চঞ্চল হয়ে উঠি এবং সর্বমার্গ পরিত্যাজ্যতে উদরমার্গের শরণ নিতে বাধ্য হই। সেই চিত্তচাঞ্চল্য থেকেই লিখতে বসা।

আটকা পড়েছিলাম বয়রা বাজারে জামাই-এর চায়ের দোকানে। তুমুল বৃষ্টিতে। জামাই-এর ব্রিফ হিস্ট্রি অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটি বলে নিই। জামাই এ অঞ্চলে জামাই হয়ে এসেছিলেন চাকরীর সন্ধানে। চাকরী-বাকরী না পেয়ে শেষে একটি চায়ের দোকান খুলে বসেন। হাতের গুণ ছিল, অচিরাৎ তিনি একজন গুণী চা-শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হন এবং রসিকজনের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। তো, সেই দোকানে তুমুল বর্ষায় আটকে পড়েছি আমি আর মেহেদী ভাই। এককাপ কড়া লিকারের চায়ে চুক-চুক করে চুমুক দিতে দিতে মেহেদী ভাইকে বললাম, “ভাই, বিষয়টা কেমন ‘বসে আঁকো’ মার্কা হয়ে যাচ্ছে না?” ভাই বললেন, “কীরকম, কীরকম?” আমি বললাম, “এই যে আমরা শিল্প-সাহিত্য-চেতনা-দেশপ্রেম নিয়ে এত কথা বলছি, কিন্তু কদিন পরে চালের দরটা যে হু হু করে বাড়বে! তখন আমার মত লোক, এই মাগ্যির বাজারে কুল্লে দশটি হাজার টাকা আয় করতে যার কোষ্ঠ কঠিন হতে হতে মার্বেল-গুলি হয়ে যায়, তার কী উপায় হবে!” ভাই গম্ভীর হয়ে বললেন, “হুম।”

আমি আবার শুরু করলাম, “গেলো বছর বোরোর সময়ে ব্রি-বালাম আঠাশের সরকারি দর ছিল প্রায় এগারোশ’ টাকা আর রত্নার মত মোটা ধানের দর ছিল আটশ’ টাকা। সেবার সরকার ধানও কেনা শুরু করেছিল ঠিক সময়ে প্রায়। ফলে ধানের বাজার ছিলো রমরমা। চাষাভুষোর দলের মুখে সেবার হাসি দেখেছিলাম। গত একটা বছর তাই চালের দরও মোটামুটি সাধ্যের মধ্যে ছিল। কিন্তু এবার যে একেবারে উল্টো! গত হপ্তা থেকে সরকারের চাল কেনার কথা থাকলেও আজ মে মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্তও চাল কেনার কোনো তোড়জোড় নেই। এদিকে হু হু করে শস্তার চাল ঢুকছে বাজারে ইন্ডিয়া থেকে। দর পড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে ফড়েরা জলের দরে ধান কিনে মহাজনের গুদামে ঢুকাচ্ছে। এরপর সব ধান যখন গুদামে ঢুকে যাবে, তখন চালের দাম আবার বাড়ালে কার সাধ্যি আর কমায়! উপসংহারে, আমার মহাবিপদ!”

শুনে ভাই বললেন, “শোন্ তাহলে-“। বলে যে কাহিনি বয়ান করলেন তা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। তলে তলে এত! সে কাহিনির অনুপুঙ্খ তথ্যাদি আমার মোটা মগজে ধরে রাখা দুষ্কর। তবে মূল ব্যাপারটা মোটামুটি এরকম। চালের বাজারের এই কলকব্জা নাড়ায় আসলে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। তাদের ভাইবেরাদররাই আবার সংসদে বসে। তাই ওইসকল ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষা করে চলা এই দেশনেতাদের বিশেষ কর্তব্য। চালের দরকার প্রতি বকৎ-এ। তাই এ জিনিসটাকে গুদোমে ভরে ফোঁটায় ফোঁটায় বাজারে ছাড়তে পারলে নিশ্চিত লাভ। সে লাভকে নিশ্চিত করতে ভাইবেরাদরের লাভের (Love) অন্ত নেই। কেননা, সে লাভের ঝড়তি-পড়তি তাদের থলেতেও জমা হয়। সবই তো ভাইবেরাদর! একেই নাকি বলে ‘সিন্ডিকেট’!

শুনে-টুনে আমি একটু মিইয়ে গেলাম। তারপরে পেলাম ভয়। কেন? না, কেবল আগামী সিজনে চালের দাম বাড়ার ভয় না, আরো বড় ভয়। শুনতে পাই এবার নাকি যে ধান ফলাতে প্রতি মণে ৭০০ টাকা খরচ হয়েছে, তা চাষী ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে বাজারের কলে পড়ে। তার নগদ টাকা দরকার। যে দোকানে অ্যাদ্দিন সদাই খেয়েছে, সে দোকানে একগাদা টাকা বাকি। পাম্পঅলাকে জলের টাকা দিতে হবে। টাকা পাবে সারের মহাজন। উপরি সার দেয়ার সময় ইউরিয়ার আকাল ছিল। সারের গায়ে তখন আগুন। সেই আগুন-দরই মহাজনের খাতায় লেখা। সব মিলিয়ে তার বড় ত্রিশঙ্কু অবস্থা। তাই চারশ’ হোক আর দুশ’ হোক সরকারের কেনার অপেক্ষায় না থেকে ধান তাকে বেচতেই হচ্ছে। কিন্তু ঢাল-তলোায়ার বিহীন নিধিরাম চাষার এ লড়াই আর কদ্দিন! রণে ভঙ্গ তো সে দিল বলে! হয় ধান চাষ ছেড়ে আর কিছু চাষ করবে, নয়তো শহরে এসে রিকশা চালাবে, মুটেগিরি করবে, ইট ভাঙবে। এইরকম একে একে সব ধানচাষী যদি চাষবাস থেকে উৎখাত হয় (হচ্ছে এবং আরো হবে, সবুর করুন), দেশে যদি একটি ধানের কণাও আর উৎপন্ন না হয়, তবে বিদেশ থেকে আসা শস্তার চাল কি আর শস্তা থাকবে? তখন প্রতি দানা চাল যদি আমদের সোনার দরে কিনতে হয়, আর কীইবা আমাদের করার থাকবে? চোখের সামনে পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আজকে যে চাল তিরিশ টাকায় কিনে খাচ্ছি কাল তা পঁয়তাল্লিশ টাকা হলো বলে। তাতেই আমার রীতিমত নাভিশ্বাস উঠে যাবে। কারণ, চুরি-চামারি তো আমার বাপ আমাকে শিখিয়ে যান নি, ইনকাম সাকুল্যে দশটি হাজার টাকা। সেটি তো আর বিশেষ বাড়ছে না। কিন্তু পরশু বা তরশু যখন চালের দাম চারগুণ হবে (হওয়াটা মোটেও অসম্ভব নয়, যদি দেশে চাষী না থাকে), তখন কী উপায় হবে! শিল্প-সাহিত্য-চেতনা-দেশপ্রেম তখন আমার কোন পিতৃপুরুষের ছেরাদ্দে লাগবে‌!

অতএব, বন্ধুগণ, ভাবুন। ভাবাটা জরুরী। বিপদটা আমার; কিন্তু আমার একলার না, সকলেরই। এই বাজার নামক দানবের যে জটিল অঙ্গসংস্থান, তার রূপটি সাধারণের কাছে তুলে ধরা দরকার। আমি গুণতে জানি না, খালি কম পড়লে টের পাই। সেই টেরটা পেয়ে যা বুঝেছি, তাই বললাম। যারা গুণতে জানেন তারা একটু গুণেটুনে বলুন। যারা অন্য আড্ডায় মশগুল, তারা একটু কান ফেরান, শুনুন। আপনাদের প্রতি গ্রাস ভাতের দোহাই, পাখি ও ফুল বিষয়ক আলোচনা মুলতুবি রেখে আপাতত ধানচাল বিষয়ে কথা বলুন। সুমনের যে গানটা দিয়ে শুরু করেছিলাম তারই শেষ লাইন কটা দিয়ে শেষ করি-

আমিও ভণ্ড অনেকের মত
গান দিয়ে ঢাকি জীবনের ক্ষত।
তবু বলি শোনো, দেখতে ভুলো না
অন্য ছবিও আঁকো!
অন্য ছবিও আঁকো!

ব্রাহ্মী শাক

তেলাকুচ-Coccinia grandisশিল্পীরা বড় বড় ওস্তাদের নাম নেয়ার সময়, তাদের গান গাইবার সময় কানে হাত ছোঁয়ান। যেমন, কোনো শিল্পী যদি মিঞা-কি-মল্লার গান, তবে আগে কানে হাত ছুঁইয়ে নেন। এটা একপ্রকার বিনয় প্রকাশ- “যে গান ওস্তাদের ওস্তাদ মিঞা তানসেন সৃষ্টি করেছেন, গেয়েছেন; তা আমি গাওয়ার দুঃসাহস করছি।” আমিও তেমনি কোনো প্রসঙ্গে আমার ওস্তাদ সৈয়দ মুজতবা আলীর নাম নিলে কানে হাত ছোঁয়াই- যে বিষয়ে রসরাজ সৈয়দ মুজতবা আলী লিখে গেছেন সে বিষয়ে আমিও ক্বচিৎ-কদাচিৎ দু-এক বাক্য লিখবার দুঃসাহস করি।

ওস্তাদ বলেন, খাদ্যবীণার ছয়টি তার। তাঁর লেখায় অবশ্য টক, ঝাল, মিষ্টি, তিতে ও নোনতা স্বাদের উল্লেখ পাই। ষষ্ঠ তারটি যে কী, তা তিনি লিখে যান নি। আমি হিসেব করে দেখলাম ষষ্ঠ তারটি হলো কটু বা কষ্টা স্বাদ। এই ছয়টি তারের মধ্যে পূর্ববাংলা, মানে বাংলাদেশের রান্নায় তিনটি স্বর মূখ্য- টক, ঝাল, তিতে। ওস্তাদ লিখব লিখব করেও বাঙালী রসনা নিয়ে বিশেষ কিছু লেখেন নি, যত লিখেছেন মোগলাই রান্না নিয়ে। বোধকরি দীর্ঘকাল পূর্ববাংলার বাইরে শান্তিনিকেতনে ও ততঃপর নানা প্রবাসে থাকায় এ বিষয়ে তাঁর আর লেখা হয়ে ওঠে নি। বিপরীতক্রমে, আমি খাঁটি চাঁড়াল বংশোদ্ভূত, নিজের এলাকার বাইরে জগৎ আছে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, বদহজমের ভয়ে মোগলাই রান্না বেশি খেতে সাহস করি না, বরং এই বাংলার চাষাভুষোর রান্নাই আমার প্রধান খাদ্য। তাই বাংলার রসনা নিয়ে একান্তই নিজের অভিজ্ঞতার উপরে ভর করে দু-চারটি কথা মাঝে মাঝে বলার চেষ্টা করি।

পদ্মার ভাটিতে গড়ে ওঠা ভূমির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এ অঞ্চলে যে বহুল প্রকারের শাকপাতা আপনাআপনি জন্মে তা দুনিয়ার আর কোথাও জন্মায় কিনা আমার জানা নেই। তাই শাকপাতা খাওয়ার ব্যাপারে এতদঞ্চলের মানুষের (বিশেষত তাদের যারা খুব বেশি ভদ্দরলোক নন) অভ্যাস বাংলাদেশের আর কারো সাথে মেলে না। হেলঞ্চ, মালঞ্চ, নটে, কাঁটানটে, ছেঁচি, ভাইতো, কলমি, আমরুলি, থানকুনি, গিমি, ব্রাহ্মী, কাঁথাছেড়া বা কাঁথাবুচুড়ে, হরেকরকম কচুশাক– এরকম অজস্র প্রকারের শাক এ তল্লাটে আপনিই জন্মায়। চাষফাষ বিশেষ করা লাগে না। প্রত্যেকটি শাকের আবার একাধিক জাতও আছে। তাদের মধ্যে রয়েছে স্বাদের অতিসূক্ষ্ম তারতম্য।

যা হোক, এতখানি ভূমিকা করলাম যে জন্যে সেইটে এবার বলে ফেলি। আজকে দুপুর রোদে বাড়ি ফিরে গরমে কাহিল অবস্থা। খিদেয় মাথা ভোঁ ভোঁ করছে, অথচ মুখে রুচি নেই একটুও। খেতে বসে জানে পানি পেলাম। ব্রাহ্মী শাক! শাকমাত্রই আমার প্রিয় বস্তু। তবে এ শাকটি একটু বেশিই প্রিয়। রুচি উৎপাদনে এর তুলনা হয় না। ভাজা ব্রাহ্মী শাক থেকে একপ্রকার ঘিয়ের মত সুঘ্রাণ বের হয়। শাকটি তিতে গোত্রভুক্ত। কবিরাজরা বলেন এই শাকে নাকি স্মৃতিশক্তি বাড়ে। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমি অবশ্য পাই নি। কারণ, ছোটবেলা থেকেই এ শাক আমি খাই, কিন্তু আজ পর্যন্ত পরীক্ষার খাতায় একটি প্রশ্নের উত্তরও আমি হুবহু মুখস্ত লিখতে পারি নি। ভুলে যাওয়ার ব্যাপারে আমার দক্ষতা বন্ধুজনের কাছে অবিদিত নয়। তবে খেতে ভালো এবং রুচিকর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করে বাঁচতে গিয়ে বহুরকম পুষ্টি উপাদানও এই বিরুৎ তার দেহে সঞ্চয় করে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, এক্কেবারে মুফতে, মানে মাগনা পাওয়া যায়। একটি পয়সা খরচ করতে হয় না ব্রাহ্মী শাক জোগাড় করার জন্য। আর কী চাই!

নটে শাক

আমার কথাটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো। সব গল্পের শেষে ওই এককথা। মাকে একদিন গল্পের শেষে জিগ্যেস করলাম, “নটে গাছ কী গো মা?” মা হেসে বললো, “কাল দেখাব।” পরদিন দেখি কোত্থেকে যেন একঝুড়ি শাকপাতা খুঁটে এনেছে। তার থেকে একটা তুলে বললো, “এ হলো নটেশাক।” আজো পষ্ট মনে আছে, সেই নটেশাক ভেজে এক চামচ ঘি দিয়ে মেখে ভাত খাইয়ে দিয়েছিল মা। সে সোয়াদ আমি এখনো ভুলতে পারি না। এরপর নটেশাক আরো অজস্রবার খেয়েছি। কিন্তু সেই অমৃততুল্য স্বাদ আজ আবার পেলাম। নটেশাক ভাজি আর এক চামচ আচারের তেল। গুটি আমের আচার। কী মধুর, কী মমতাময় মোলায়েম সে আস্বাদ! তাকে জিহ্বা দিয়ে গ্রহণ করা চলে না, গ্রহণ করতে হয় হৃদয় দিয়ে। অন্ত্রের পাচক রসে তা জীর্ণ হয় না, তাকে জীর্ণ করতে হয় অন্তরের জারক রসে। তার মূল্য কেবল পুষ্টিতে নয়, তার আসল মূল্য তুষ্টিতে।

কদলীপুষ্প ও গাছপাঁঠা

হাঁসফাঁস লাগছে। বাড়িঅলার ব্যাটার বউ মোচার ঘণ্ট রেঁধে দিয়ে গিয়েছিলো। খেয়েই বুঝলাম দয়া কলার মোচা! সর্বপ্রকার মোচার মধ্যে দয়াকলার মোচাই সবচেয়ে সুস্বাদু। এর পরেই আছে কাঁঠালি কলা, ঠোঁটে কলা আর জিন কলার মোচা। তবে কাঁচকলার মোচাটা বিচ্ছিরি। তিতকুটে। আর যাই হোক শ্রীমতির রান্নার হাতটি বেড়ে। মোচাটা জমিয়েছেন ভালো। তবে স্নেহটা (মানে তেলটা) একটু বেশি পড়ে যায়, এই যা (কাঁচা বয়েস, তা তো একটু পড়তেই পারে)। তবে কালে কালে বড় শিল্পী হবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

খানিকটা এঁচোড় ছিল ঘরে। চিংড়ি দিয়ে কষা হবে বলে রাখা। ও মা! এক রাতের মধ্যে দেখি পেকেটেকে হলদে হয়ে গেছে! তার কোষগুলো ফেলে দিয়ে শুধু বিচিগুলো আলু দিয়ে একটা দম মত হয়েছে। সাথে ডাঁটা দিয়ে মটরের ডাল। শেষে অম্বল। আমের। এখানেই শেষ নয়। সব কিছুর সাথে সেই মৌরলা মাছ আর চিংড়ি ডুবো তেলো পাঁপড়ের মত করে ভেজে তোলা। কামড় দিয়ে খাওয়ার জন্য। আহা! কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর? শেষে সর্বরসের নির্যাসসমৃদ্ধ সুরুয়াটুকু এক চুমুকে সাবাড় করে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। একেই বলে ‘উকুন মারা খাওয়া’‒ পেটে উকুন রেখে চাপ দিলে পটাস করে ফেটে যাবে।