সেই ছোট্ট ভবঘুরে

Limelight Posterওস্তাদ যেভাবে লিখেছেন, তেমন লেখা তো আর লিখতে পারব না! আমার ওস্তাদও মজেছিলেন তার রসে। সে কথা যেরকম সরসে বয়ান করেছেন, তেমনটি আর কেউ পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তাঁর বিদেহী পদযুগলে হাজারখানেক সেলাম ঠুকে আমি একটুখানি লেখার দুঃসাহস করি। ও হ্যাঁ, আমার ওস্তাদের নাম সৈয়দ মুজতবা আলী (কানে হাত)।

ছবির নাম ‘লাইমলাইট’। কাহিনী সবিস্তারে বলা ফিলিমরসিকদের রীতিবিরুদ্ধ কাজ (তেমন খ্যাপাটে দর্শক হলে তেড়ে মারতে আসে)। তবে, এ ছবিখানা আমার মতন নাদান আহাম্মুক ছাড়া রসিক লোক সবাই দেখে ফেলেছেন বলেই সন্দ করি। আমার এই উচ্ছাস দেখে মুখ টিপে বা হো হো করে হাসলেও আশ্চর্য হব না। কিন্তু সত্য কথা এই যে, ছবিখানা আমায় দেগেছে ভালরকমেই। বহু-বহু সিনেমা আমি দেখি নি। তাই দুনিয়ার বহু-বহু কলাকারের কাজ আমার অজানা। তবে এই ছোটখাট মানুষটিকে ভালবাসি বড়। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে, “জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো”। এই ট্রাম্প কমেডির অবতারটি দুনিয়ায় এসেছিলেন হাসিকান্নার বিমিশ্র ধারা হয়ে। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবার মধ্যেও চোখটা ঝপ করে জলে ঝাপসা হয়ে আসে।

A Scene
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানটিও সকলেরই শোনা আছে বলে সন্দ হয়। চ্যাপলিনকে নিয়ে অমন গান আমি দ্বিতীয়টি শুনি নি (আবারও কানে হাত দিয়ে স্বীকার করি, গানও আমি দু-চারখানার বেশি শুনি নি)।

সেই ছোট্ট দুটো পা
ঘুরছে দুনিয়া
ছোট্ট দুটো চোখে স্বপ্নের দূরবীন
কাছে যেই আসি
মুখে ফোটে হাসি
তবু কোথায় যেন বাজে
করুণ ভায়োলিন …

এই গানে এক জায়গায় আছে ‘লাভ লাভ লাভ লাভ লাভ লাভ লাভ লাভ লাভ লাভ’। এই লাভ-এর রেলগাড়িটা আসলে ওই ছবিরই একটা গানের মধ্যে আচ্ছে। সাংঘাতিক সুন্দর একটা গান। যারা কিনা দিনান্তে একবার সুইসাইড করার কথা ভাবেন, তারা দয়া করে এই গানটি একবার শুনবেন। একটা দিন অন্তত বেশি বাঁচতে ইচ্ছে হবে, আমার মুর্শিদের কসম!

Claire Bloom and Charlie Chaplin
একজন বিগতযশা ট্রাম্প কমেডিয়ান আর এক হতাশ ব্যালেরিনার কাহিনী ‘লাইমলাইট’। ভালবাসার গল্প। জীবনের গল্প। নিরাশা নিরন্ধ্র আন্ধারে জীবনকে ভালবেসে বাঁচার গল্প।

ভালবাসা নাও চার্লস চ্যাপলিন…
ভালবাসা ছড়াও চার্লস চ্যাপলিন
পৃথিবীর বুকে উষর মরুতে ফুল ফোটাও
চার্লস চ্যাপলিন

আকাদেমি সমাচার

/images/কাক্কেশ্বর.pngদুপুরবেলা চাট্টি খাওয়ার পরে পোষ মাসে বেশ একটু শীত-শীত করে। লেপের মধ্যে হাত-পা সেঁধিয়ে বেশ একটু মটকা মেরে পড়ে থাকতে নেহাত মন্দ লাগে না। আজকে দুপুরেও সেই আয়োজনই হচ্ছিল। খাওয়াটাও হয়েছে বেড়ে! পুঁই শাকের মিচলির চচ্চড়ি, মৌরলার ঝোল আর আমরুলি শাকের তোফা একটা অম্বল দিয়ে চাট্টি গরম ভাত খেয়ে যেই না লেপ মুড়ি দেবার উদ্‌যোগ কচ্ছি, এমন সময়, কে যেন ভাঙা-ভাঙা ভারী মোটা গলায় ডেকে উঠল, “কাআআআ!”

কী আপদ! এই মটকা মারার সময়ে আবার এমন বিচ্ছিরি আওয়াজ করে কে! তাকিয়ে দেখি, উঠোনে কাপড় নাড়া যে তারটি রয়েছে, তার উপরে বসে আছে স্বয়ং কাক্কেশ্বর। শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে। দেখে লাফিয়ে উঠলাম। সেই কবেকার কথা! আট বছর বয়সে দেখা হয়েছিল কাক্কেশ্বরের সাথে। কী সব হিসেবটিসেব করার একটা ব্যাবসা খুলেছিল। তারপর, সেই যে কোর্ট চত্ত্বর থেকে পাখা ঝাপটে কোথায় চলে গেল, অ্যাদ্দিন পরে এই দেখা! তাও আমারই উঠোনে! বিশ্বাস হতে চাইছিলো না। ভাবলাম এবারও সেবারকার মত স্বপ্ন দেখছি না তো! চোখটোখ কচলে দেখলাম, না, ঠিকই আছে। কাক্কেশ্বরই। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বললাম, “আরে কাক্কেশ্বর যে!” বুড়ো হয়ে গেছে বেচারা। কুচকুচে উপাধিটা এখন আর তার নামের সাথে যায় না। উষ্কোখুষ্কো পালক, সেই চিক্কণ কৃষ্ণবর্ণ এখন আর নেই। বললাম, “কোত্থেকে অ্যাদ্দিন পরে? কী করছো-টরছো কী আজকাল? তোমার সেই হিসেবের ব্যাবসা আছে এখনো?”

কাক্কেশ্বর বলল, “কী যে বলো! এখন হলো কম্পিউটারের যুগ, ডিজিটাল যুগ। আমার হিসেব কী এখন চলে! সে ব্যাবসা লাটে উঠেছে বহুদিন আগে।”

একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে চোখ মটকে ফিসফিস করে আমাকে বললো, “একটা নতুন ব্যাবসা খুলেছি!” আমিও অতি আগ্রহে জিগ্যেস করলাম, “কী ব্যাবসা?!!” কাক্কেশ্বর তখন একতাড়া কাগজের মধ্য থেকে একটা কাগজ আমার হাতে দিল। দেখলাম একটা হ্যান্ডবিল। কম্পিউটার কম্পোজ করে ফটোকপি করা। ঘষা ঘষা লেখা, পড়তে একটু কষ্ট হয়। দেখলাম,তাতে লেখা রয়েছে–

শ্রীশ্রীভূশণ্ডিকাগায় নমঃ
শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্‌কুচে
৪১নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটি

বাংলা একাডেমী অনুমোদিত

১ নং দিশি লঘুকৃত রেক্টিফায়েট স্পিরিট বা বংলা মদ

হে সূরামোদী বঙ্গবাসী, তামাম বঙ্গাল মুলুকে আমরাই বাংলা মদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য পরিবেশক। একশতভাগ খাঁটি রেক্টিফায়েড স্পিরিটের সাথে শতভাগ শুদ্ধ পাতিত জল বা ডিস্টিলড্ ওয়াটার মিশিয়ে এই মদ প্রস্তুত করা হয়। আপনার ঠিকানা আমাদের লিখে পাঠালে বা ইমেইল করলে বা এসএমএস করলে আমরা বোতল পার্শেল করে থাকি। মূল্য প্রতি লিটার ২৫০ টাকা, পার্শেল ফি ১০০ টাকা। নেশা না হলে মূল্য ফেরত।

সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!

আমরা সনাতন বায়সবংশীয় দাঁড়িকুলীন, অর্থাৎ দাঁড়কাক। আজকাল নানাশ্রেণীর পাতিকাক, হেঁড়েকাক, রামকাক প্রভৃতি নীচশ্রেণীর কাকেরাও অর্থলোভে নানারূপ ভেজাল মদের ব্যবসা চালাচ্ছে। সাবধান! তাদের মেথিলেটেড স্পিরিট মিশ্রিত মদ খেয়ে অক্কা পাবেন না!

***
মনে রাখবেন, আমরাই বাংলা একাডেমী স্বীকৃতি একমাত্র বাংলা মদ পরিবেশক।



আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! “কাক্কেশ্বর! কী লিখেছ এসব! বাংলা একাডেমির কাজ তো শুনেছি ভাষাটাষা, বইপত্তর নিয়ে। তারা আবার মদের লাইসেন্স দেয়া শুরু করলো কবে থেকে? আশ্চর্য!”

শুনে কাক্কেশ্বর “তাও জানো না!” বলে সেই লাল হুলো বেড়ালটার মত বিশ্রীরকমে ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ হাসতে লাগলো। আমি বললাম, “না জানি না। হেয়ালি না করে ভেঙে বলো তো দেখি ব্যাপারখানা।”

কাক্কেশ্বর এক চোখ বুজে কী যেন খানিক ভাবলো। তারপর বলল, “শোনো”। বলেই আবার দু চোখ বুজে বসে রইলো। তারপর, চোখ দুটো খুলে গোল গোল চোখে হড়বড় করে বলতে শুরু করলো, “এদিকে হয়েছে কী, শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন ভাই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার ফরম তুলতে গিয়ে শোনে তাকে ফরম দেবে না! কী কাণ্ড! কেন দেবে না!? মহাপরিচালক মুখ খিচিয়ে বলল, ‘কেন রে শালা! এখন কেন! তখন তো আমাদের পোঙায় খুব কাঠি দিয়েছিলি। তখন মনে ছিল না? যা ভাগ! দু-বছরের মধ্যে যেন এ তল্লাটে আর না দেখি!’ রবিন ভাইও শাসিয়ে এলো, ‘দেখব শালা তুমিও কেম্নে মেলা করো। আমি কাউন্টার মেলা ডাকব! হুঁ!’ মহাপরিচালক চোখমুখ লাল করে বলল, ‘যা যা ফকড়েমি করিসনে! তোদের মত দু পয়সার প্রকাশক আমি ‘টুট’ দিয়েও গুণি না!’ পরদিন হৈ হৈ রৈ রৈ মার মার কাট কাট! মিছিল-সমাবেশ-সেপাই-পল্টন-লাঠি-কাঁদানে গ্যাস, একেবারে ধুন্ধুমার কাণ্ড! প্রকাশকরা সব বেঁকে বসল, বাংলা একাডেমী বারান্দায়ও আর কেউ যায় না। অগত্যা বাংলা একাডেমী বলল, ‘বইপত্তরের কাজই বন্ধ। এখন থেকে আমরা বাংলা মদের লাইসেন্স দেব।’ আমি খবর পেয়েই কাগেয়াপটি থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে একটা লাইসেন্স নিয়ে নিলাম। শালারা মোটা টাকা খেয়েছে জানো! সব জায়গায় জোচ্চুরি! ব্যাস্! এই হলো আমার নতুন ব্যাবসার গল্প! লাগবে নাকি তোমার? তোমার জন্য কনসেশন আছে।”

আমি ভাবছি, এইবেলা কাক্কেশ্বরকে দু লিটারের অর্ডার দেব। খাটের তলায় লুকিয়ে রেখে সন্ধেবেলাটায় বেশ কদিন একটু মৌতাত হবে! বাংলা একাডেমী অনুমোদিত বাংলা বলে কথা! এমন সময়! কে যেন পিছন থেকে ঝুঁটি ধরে টানতে লাগল। শুনলাম মায়ের গলা, “এই ভর সন্ধেবেলায় কেমন ঘুমুচ্ছে দেখ! এমন আটকুঁড়ে ঊনপাঁজুরে ছেলে আমি জম্মে দেখিনি বাপু! কোনো কাজেকম্মে নেই, কেবল পড়ে পড়ে ঘুমোনো! হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলো একেবারে! ওঠ হতচ্ছাড়া! ওঠ বলছি!”

বুকের মধ্যে তখন বেজে চলেছে–

“আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারোর দানে পাওয়া নয়….”

সর্দার সিয়াটলের চিঠি - আমেরিকার প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে (১৮৫২)

সর্দার সিয়াটলওয়াশিংটনের প্রেসিডেন্ট বলে পাঠিয়েছেন যে তিনি আমাদের জমি কিনতে চান। কিন্তু আকাশ কি আপনি বেচাকেনা করতে পারেন? ভূমি? এই ধারণাটাই আমাদের কাছে আজব! আমরা যদি বাতাসের পরিচ্ছন্নতা আর জলের চকমকির মালিক না হই, তবে আমরা তা বিক্রি করব কীভাবে? এই পৃথিবীর প্রতিটি অংশই আমার মানুষের কাছে পবিত্র। পাইন গাছের প্রতিটি সূঁচালো পাতা, পোকামাকড়ের গুঞ্জন; সবই আমার জনগণের পবিত্র স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা।

গাছের দেহের ভিতরে বয়ে চলা প্রাণরস আমরা তেমনই জানি, যেমন জানি আমাদের ধমনীতে বয়ে চলা রক্তস্রোত। আমরা এই পৃথিবীর অংশ, এই পৃথিবীও আমাদেরই অংশ। সুরভিত ফুল আমাদের বোন। ভাল্লুক, হরিণ, বিরাট ঈগল; এরা আমাদের ভাই। এই পাহাড়শ্রেণী, এই সরেস তৃণভূমি, এই টাট্টু ঘোড়াটির দেহের ওম, এবং একটি মানুষ— এরা সবাই একই পরিবারের অংশ।

নদীর স্রোতে যে উজ্জ্বল জলধারা বয়ে যায় তা নেহায়েতই জল নয় শুধু, তা আমাদের পূর্বপুরুষের রক্ত। আমরা যদি আপনাদের কাছে জমি বিক্রি করি, আপনাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে তা পরম পবিত্র। হ্রদের স্বচ্ছ জ্বলে প্রতিটি অতীন্দ্রিয় প্রতিচ্ছবি আমার মানুষদের জীবনের অগুনতি ঘটনা আর স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। জলের কলোচ্ছ্বাসে আমি আমার পিতা-পিতামহদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। এইসব নদীরা আমাদের ভাইয়ের মত। তারা আমাদের তেষ্টা মেটায়। আমাদের নৌকা বয়ে নিয়ে যায়, আমাদের বাছাদের মুখে খাবার যোগায়। তাই নদীর প্রতি আপনারা তেমনই সদয় হবেন, যেমন সদয় আপনারা আপনাদের ভাইদের প্রতি।

যদি আমরা আমাদের জমি বিক্রি করি, মনে রাখবেন যে বাতাস আমাদের কাছে কত মূল্যবান! মনে রাখবেন, বাতাস তার প্রাণশক্তি দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বাতাস আমাদের পিতামহদের প্রথম প্রশ্বাসটি দান করেছে, আর শেষ নিশ্বাসটি গ্রহণ করেছে। বাতাস আমাদের সন্তানদেরও দিয়েছে তার অফুরাণ প্রাণের অংশ। তাই, যদি আমরা আমাদের জমি বিক্রি করি, আপনারা অবশ্যই একে এমনই স্বতন্ত্র ও পবিত্র করে রাখবেন, যেন সেখানে মানুষ যেতে পারে তৃণপুষ্পের সূধাসৌরভে পুষ্ট পরিচ্ছন বায়ু সেবন করতে।

আপনারা কি আপনাদের সন্তানদের তা-ই শেখাবেন, যা আমরা আমাদের সন্তানদের শিখিয়েছি? শেখাবেন যে এই পৃথিবী আমাদের মা? যা কিছু এ পৃথিবীর কোলে আছড়ে পড়ে তা সবই তার সন্তান?

এটাই আমরা জানি: পৃথিবী মানুষের জন্য নয়, মানুষ এই পৃথিবীর জন্য। সবকিছুই রক্তসম্পর্কের মত যা আমাদের একসূত্রে গেঁথে রেখেছে। জীবনের এই জাল মানুষ বোনে নি, সে বড়জোর তার একটা সুতো মাত্র। এই জালের যেখানে সে যা-ই করুক, সে আসলে নিজেরই উপরেই তা করছে।

একটি বিষয় আমরা জানি: আমাদের ঈশ্বর তোমাদেরও ঈশ্বর। এই পৃথিবী তাঁর কাছে মূল্যবান এবং এই পৃথিবীর কোনো ক্ষতি করা তাঁর সাথেই চরম বেআদবি করার সমান। তোমাদের গন্তব্য আমাদের কাছে এক রহস্য! কী হবে, যখন সব মোষ জবাই করা হয়ে যাবে? সবগুলো ঘোড়া যখন বন্দী হয়ে যাবে? কী হবে, যখন বনভূমির গভীরতম অঞ্চল মানুষের গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে আর সমুচ্চ পাহাড়শ্রেণী আচ্ছন্ন হয়ে যাবে কথাবলা তারে? ঘন ঝোপঝাড় কোথায় থাকবে? চলে যাবে! ঈগলেরা কোথায় থাকবে? চলে যাবে! এই টাট্টু ঘোড়া আর শিকারদের বিদায় জানানোকে কী বলব? বেঁচে থাকার সমাপ্তি আর টিকে থাকার শুরু।

যখন শেষ লাল আদিবাসী মানুষটি তার বন্যতা নিয়ে উধাও হবে আর তার তার স্মৃতি কেবলই মেঘের ছায়ার মত এই প্রেইরিতে ঘুরে বেড়াবে, এই তটভূমি আর এই অরণ্য কি সেদিন এখানে থাকবে? আমার মানুষদের একটি আত্মাও কি এখানে থাকবে?

আমরা এই পৃথিবীকে তেমনিভাবেই ভালবাসি, যেমনিভাবে সদ্যজাত শিশু তার মায়ের হৃদয়ের ধ্বনি ভালবাসে। তাই যদি আমরা আমাদের জমি তোমাদের কাছে বিক্রি করি, তোমরাও তাকে তেমনই ভালবেসো যেমন আমরা বাসি। তেমনিভাবেই এর যত্ন নিয়ো, যেমন আমরা নিয়েছি। এই ভূমির স্মৃতি যেমনটি আছে ঠিক তেমনই মনের মধ্যে ধরে রেখো। এই ভূমিকে সব সন্তানের জন্য রক্ষা কোরো ও ভালবেসো, যেমন ঈশ্বর আমাদের বাসেন।

আমরা যেমন এই ভূমির অংশ, তোমরাও তেমনই। এ পৃথিবী আমাদের কাছে মূল্যবান। তেমনি মূল্যবান তোমাদের কাছেও। একটি কথা আমরা জানি: একজনই ঈশ্বর। সাদা-কালো মানুষে মানুষে ভেদ নেই কোনো, ভেদ শুধু মানুষের সাথে তাঁর। আমরা সবাই সবার ভাই।

জীবন যখন শুকায়ে যায়...

তেলাকুচ Coccinia grandisদুপুরবেলায় খেয়েদেয়ে একটা পাতলা ঝিম্ মত এসেছে। ঝিমের মধ্যে একচোখ বুজে আরেক চোখ আদ্ধেক বুজে ভাবছিলাম… “কী দুনিয়া, কী হয়ে গেল! মানবজাতির ভবিষ্যৎটাই বা কী? এত যুদ্ধ, এত রক্তপাত, এত হানাহানি!” ভাবছিলাম, “কেন বেঁচে আছি! মরে গেলেই বা ক্ষতি কী!” কিন্তু মরার কথা ভাবতেই পেটের মধ্যে কেমন পাক দিয়ে উঠল। সদ্য খাওয়া তেলাকুচের লতা আর পার্শে মাছ যেন একযোগে মিছিল শুরু করে দিল! “মানি না, মানব না!” এই হলো জ্বালা! মরা দূরস্থান, মরার কথা ভাবতে গেলেই আমার পেট কুঁই কুঁই করে ওঠে। আহা! এত বিচিত্র খাদ্যসম্ভার ত্যাগ করে ঠুস করে মরে যেতে হবে ভাবলেই ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। স্বর্গ বলুন, নরক বলুন, পদ্মার অববাবহিকায় জন্ম নেয়া এই অজস্র শাকলতা আর স্বাদুপানি ও লোনাপানির সঙ্গমে জন্ম নেয়া এই বিচিত্র মৎসকূল ছেড়ে ফুটুস করে মরেটরে যাওয়া একদমই কাজের কথা না।

তেলাকুচ বস্তুটা অদ্ভূত। ঠিক তিতে না। কিন্তু একটা আঘ্রাণ আছে দারুণ। কচি ডাঁটাগুলো মুখে পুরে যতক্ষণ খুশি চিবোনো যায়। বড়ই আরাম। শুনেছি কী সব নাকি ঔষধি গুণাগুণ আছে, ডায়াবেটিস-ফায়াবেটিস নাকি সারে-টারে। তা হোক গে। আমার ও নিয়ে আগ্রহ নেই। খেতে ভাল, সেটাই আসল কথা। আমিষ বা নিরামিষ, সবরকমেই ভাল লাগে। নিরামিষ রাঁধলে কতকটা সুক্ত রাঁধার কায়দায় রাঁধতে হয়। আর মাছ হলে তো কথাই নেই! একটু মাখোমাখো ঝোল হবে। তোফা! আজকে মা সেই বস্তু রেঁধেছিলেন। তেলাকুচে শাক, কাঁচকলা, আলু আর পার্শে মাছের ঝোল। তার সাথে কেওড়ার অম্বল। বাদাবনের ফল। বেজায় টক। কিন্তু অম্বলটি বড় ভাল। সর্ষে ফোড়ন দিয়ে জলটক। খেয়ে অব্দি কেমন নেশা নেশা লাগছে। এই আধাচোখও আর খুলে রাখতে পারছি না। যাই আরেকটু ঝিমিয়ে নিই…

বান্ধবী সমাচার

তবুও তোমায় জেনেছি, নারি, ইতিহাসের শেষে এসে; মানবপ্রতিভার
রূঢ়তা ও নিষ্ফলতার অধম অন্ধকারে
মানবকে নয়, নারি, শুধু তোমাকে ভালোবেসে
বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে ।
‒জীবনানন্দ দাশ

হালে ‘বান্ধবী’ কথাটাকে ইংরেজি ‘গার্লফ্রেন্ড’ শব্দটার সমার্থক হিসেবে ব্যবহারের চল শুরু হয়েছে। খুবই অসৎ চেষ্টা। কেননা, বান্ধবী কথাটা মোটেও গার্লফ্রেন্ডের সমার্থক না। ইংরেজিতে গার্লফ্রেন্ড বলতে যা বোঝায় তা বাংলাতে ‘প্রেমিকা’ কথাটার একটা লঘুতর সংস্করণ। কেননা, প্রেমিকা শব্দটির যে সুগভীর আবেদন আছে, তা গার্লফ্রেন্ড শব্দটিতে নেই। অপরদিকে, বান্ধবী কথাটা মূলগতভাবে বন্ধু শব্দের লিঙ্গান্তর। তার সাথে রোমান্স না প্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছুদিন আগে পর্যন্তও সহপাঠিনী বা সমবয়সী বা শৈশব থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা কোনো মেয়ে বন্ধুকে একটা ছেলের জন্য বান্ধবী পরিচয় দিতে কোনো অসুবিধে ছিল না। গার্লফ্রেন্ডের সমার্থক হিসেবে কথাটা চালু করার চেষ্টার ফলে সেটি আজকাল একটু কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। যদি বলি, ‘মেয়েটি আমার বান্ধবী।’ তখন উল্টো প্রশ্ন, ‘মানে গার্লফ্রেন্ড?’ তখন ব্যাখ্যা দিতে হয়, ‘না, স্রেফ বন্ধু।’ প্রশ্নকর্তা তাতেও সন্তুষ্ট হন না, ‘আরে কিছু থাকলেও বা কী সমস্যা! লজ্জা পাচ্ছ কেন?’ একটি শব্দের সহজ সুন্দর অর্থকে একটি দুরভিসন্ধিমূলক অর্থ দ্বারা প্রতিস্থাপনের এই চেষ্টা খুবই দুঃখজনক।

কেন আমি মেয়ে বন্ধুটিকে বান্ধবী বলতে চাই, তার একটা কারণ আছে। কারণ, বান্ধবী শব্দটি বন্ধুর চেয়ে আরো গভীর, ব্যপক ও মমতাপূর্ণ। বান্ধবী, সে কোনো ছেলের বান্ধবী হোক বা কোনো মেয়ের, অপর কোনো ‘বন্ধু’র চেয়ে বেশি সহৃদয়, নির্ভরযোগ্য ও সহনশীল। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে নারীরা মানবচরিত্রের শ্রেষ্ঠ কিছু গুণাবলী অর্জন করেছে। সেগুলো পুরুষ এখনো অর্জন করে উঠতে পারে নি। পুরুষ অধিপতি চরিত্রে থাকায় সমাজের কাছ থেকে সে গড়পড়তায় শোষকের মনস্তত্ত্ব অর্জন করেছে। ফলে মানুষের (মানুষটি পুরুষ বা নারী যাই হোক) একজন পুরুষ বন্ধু যতখানি সহৃদয় চরিত্র, নারীবন্ধু তার চেয়ে বেশি সহৃদয় হয়। এই কারণে, বন্ধুর চেয়ে বান্ধবী গুণগতভাবে উন্নত।

বান্ধবী কথাটা ব্যবহার করতে গিয়ে একধরণের প্যারাডক্স তৈরি হয়। ধরুন, আমার একটি বান্ধবী আছে। একজন বলে বসলো, ‘ওর সাথে তো তোমার প্রেম।’ আমি সবিনয়ে বলি, “না, আপনার সাথে আমার যেমন বন্ধুতা হওয়া সম্ভব, ওর সাথেও তেমনি বন্ধুত্ব।” মন্তব্যকারীর উত্তর, “ওটাও একরকমের প্রেম।” তা বটে। বাংলা ভাষায় প্রেম শব্দটার বিবিধ অর্থ আছে। রকমফেরও আছে বহু। দেশপ্রেম, ভাতৃপ্রেম, বন্ধুপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেম প্রভৃতি। আমার বান্ধবীর সাথে আমার যে সম্পর্ক, তা এরকম কোনো না কোনো অর্থে বা রকমফেরে প্রেম বলে চালিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু, মনে রাখতে হবে প্রেম বলতে মানুষ প্রথমত বোঝে ‘যুবকযুবতীর ধ্বংসরহিত ভাববন্ধন’ (বঙ্গীয় শব্দকোষ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) অর্থাৎ রোমান্স। অতএব, যে কোনো সম্পর্ককে প্রেম বলে চালিয়ে দিতে গেলে মানুষের পক্ষে সেটাকে একটা রোমান্টিক সম্পর্ক ভেবে নেয়ার সুযোগ থাকে। সেটি কখনো কখনো বিব্রতকর। বান্ধবীর সাথে আমার যে সম্পর্ক তাতে ভালবাসা বিলক্ষণ আছে, আমার অপরাপর বন্ধুদের প্রতি যেমন থাকে। তার চেয়ে হয়তো একটু বেশিই আছে। কিন্তু তা বলে, সেটা রোমান্স হতে হবে তা নয়। সুতরাং, বান্ধবী কথাটা উচ্চারণ করলেই রোমান্সের গন্ধ খোঁজাটা একটা বিকৃতির লক্ষণ।