অন্য ছবিও আঁকো!

এঁকো না কখনো স্বদেশের মুখ
তোবড়ানো গাল ভেঙে যাওয়া বুক
মরোমরো তার পরানভোমরা
বসে আঁকো, বসে আঁকো!
–কবীর সুমন

ক্ষুধার যে একটি যন্ত্রণা আছে এবং তা সে যন্ত্রণা যে সর্বসুখযন্ত্রণহর; তা প্রতি বক্‌ৎ-এ যারা পেটপুরে চর্ব্যচোষ্য খেয়ে বড় হয়েছেন তারা ঠিক বুঝতে পারবেন না। ক্ষুধা ও খাবার বিষয়ক আলোচনা তাই তাদের কাছে নিতান্তই হীন ও আতরাফ জাতের মনে হবে তাতে আশ্চর্য কী! কিন্তু আমি জন্ম নিয়েছি ও বেড়ে উঠেছি ক্ষুধার রাজ্যে। নিজে সে যন্ত্রণা খুব প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করার সুযোগ না হলেও ক্ষুধা নামক প্রবৃত্তি যে মানুষের আছে এবং তার নিবৃত্তি যে অনিবার্য একটি প্রয়োজন; তা বিলক্ষণ উপলব্ধি করেছি। আমি অতএব, ক্ষুধা নিবৃত্তির পথে অশনি সংকেত পেলে যারপরনাই চঞ্চল হয়ে উঠি এবং সর্বমার্গ পরিত্যাজ্যতে উদরমার্গের শরণ নিতে বাধ্য হই। সেই চিত্তচাঞ্চল্য থেকেই লিখতে বসা।

আটকা পড়েছিলাম বয়রা বাজারে জামাই-এর চায়ের দোকানে। তুমুল বৃষ্টিতে। জামাই-এর ব্রিফ হিস্ট্রি অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটি বলে নিই। জামাই এ অঞ্চলে জামাই হয়ে এসেছিলেন চাকরীর সন্ধানে। চাকরী-বাকরী না পেয়ে শেষে একটি চায়ের দোকান খুলে বসেন। হাতের গুণ ছিল, অচিরাৎ তিনি একজন গুণী চা-শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হন এবং রসিকজনের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। তো, সেই দোকানে তুমুল বর্ষায় আটকে পড়েছি আমি আর মেহেদী ভাই। এককাপ কড়া লিকারের চায়ে চুক-চুক করে চুমুক দিতে দিতে মেহেদী ভাইকে বললাম, “ভাই, বিষয়টা কেমন ‘বসে আঁকো’ মার্কা হয়ে যাচ্ছে না?” ভাই বললেন, “কীরকম, কীরকম?” আমি বললাম, “এই যে আমরা শিল্প-সাহিত্য-চেতনা-দেশপ্রেম নিয়ে এত কথা বলছি, কিন্তু কদিন পরে চালের দরটা যে হু হু করে বাড়বে! তখন আমার মত লোক, এই মাগ্যির বাজারে কুল্লে দশটি হাজার টাকা আয় করতে যার কোষ্ঠ কঠিন হতে হতে মার্বেল-গুলি হয়ে যায়, তার কী উপায় হবে!” ভাই গম্ভীর হয়ে বললেন, “হুম।”

আমি আবার শুরু করলাম, “গেলো বছর বোরোর সময়ে ব্রি-বালাম আঠাশের সরকারি দর ছিল প্রায় এগারোশ’ টাকা আর রত্নার মত মোটা ধানের দর ছিল আটশ’ টাকা। সেবার সরকার ধানও কেনা শুরু করেছিল ঠিক সময়ে প্রায়। ফলে ধানের বাজার ছিলো রমরমা। চাষাভুষোর দলের মুখে সেবার হাসি দেখেছিলাম। গত একটা বছর তাই চালের দরও মোটামুটি সাধ্যের মধ্যে ছিল। কিন্তু এবার যে একেবারে উল্টো! গত হপ্তা থেকে সরকারের চাল কেনার কথা থাকলেও আজ মে মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্তও চাল কেনার কোনো তোড়জোড় নেই। এদিকে হু হু করে শস্তার চাল ঢুকছে বাজারে ইন্ডিয়া থেকে। দর পড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে ফড়েরা জলের দরে ধান কিনে মহাজনের গুদামে ঢুকাচ্ছে। এরপর সব ধান যখন গুদামে ঢুকে যাবে, তখন চালের দাম আবার বাড়ালে কার সাধ্যি আর কমায়! উপসংহারে, আমার মহাবিপদ!”

শুনে ভাই বললেন, “শোন্ তাহলে-“। বলে যে কাহিনি বয়ান করলেন তা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। তলে তলে এত! সে কাহিনির অনুপুঙ্খ তথ্যাদি আমার মোটা মগজে ধরে রাখা দুষ্কর। তবে মূল ব্যাপারটা মোটামুটি এরকম। চালের বাজারের এই কলকব্জা নাড়ায় আসলে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। তাদের ভাইবেরাদররাই আবার সংসদে বসে। তাই ওইসকল ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষা করে চলা এই দেশনেতাদের বিশেষ কর্তব্য। চালের দরকার প্রতি বকৎ-এ। তাই এ জিনিসটাকে গুদোমে ভরে ফোঁটায় ফোঁটায় বাজারে ছাড়তে পারলে নিশ্চিত লাভ। সে লাভকে নিশ্চিত করতে ভাইবেরাদরের লাভের (Love) অন্ত নেই। কেননা, সে লাভের ঝড়তি-পড়তি তাদের থলেতেও জমা হয়। সবই তো ভাইবেরাদর! একেই নাকি বলে ‘সিন্ডিকেট’!

শুনে-টুনে আমি একটু মিইয়ে গেলাম। তারপরে পেলাম ভয়। কেন? না, কেবল আগামী সিজনে চালের দাম বাড়ার ভয় না, আরো বড় ভয়। শুনতে পাই এবার নাকি যে ধান ফলাতে প্রতি মণে ৭০০ টাকা খরচ হয়েছে, তা চাষী ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে বাজারের কলে পড়ে। তার নগদ টাকা দরকার। যে দোকানে অ্যাদ্দিন সদাই খেয়েছে, সে দোকানে একগাদা টাকা বাকি। পাম্পঅলাকে জলের টাকা দিতে হবে। টাকা পাবে সারের মহাজন। উপরি সার দেয়ার সময় ইউরিয়ার আকাল ছিল। সারের গায়ে তখন আগুন। সেই আগুন-দরই মহাজনের খাতায় লেখা। সব মিলিয়ে তার বড় ত্রিশঙ্কু অবস্থা। তাই চারশ’ হোক আর দুশ’ হোক সরকারের কেনার অপেক্ষায় না থেকে ধান তাকে বেচতেই হচ্ছে। কিন্তু ঢাল-তলোায়ার বিহীন নিধিরাম চাষার এ লড়াই আর কদ্দিন! রণে ভঙ্গ তো সে দিল বলে! হয় ধান চাষ ছেড়ে আর কিছু চাষ করবে, নয়তো শহরে এসে রিকশা চালাবে, মুটেগিরি করবে, ইট ভাঙবে। এইরকম একে একে সব ধানচাষী যদি চাষবাস থেকে উৎখাত হয় (হচ্ছে এবং আরো হবে, সবুর করুন), দেশে যদি একটি ধানের কণাও আর উৎপন্ন না হয়, তবে বিদেশ থেকে আসা শস্তার চাল কি আর শস্তা থাকবে? তখন প্রতি দানা চাল যদি আমদের সোনার দরে কিনতে হয়, আর কীইবা আমাদের করার থাকবে? চোখের সামনে পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আজকে যে চাল তিরিশ টাকায় কিনে খাচ্ছি কাল তা পঁয়তাল্লিশ টাকা হলো বলে। তাতেই আমার রীতিমত নাভিশ্বাস উঠে যাবে। কারণ, চুরি-চামারি তো আমার বাপ আমাকে শিখিয়ে যান নি, ইনকাম সাকুল্যে দশটি হাজার টাকা। সেটি তো আর বিশেষ বাড়ছে না। কিন্তু পরশু বা তরশু যখন চালের দাম চারগুণ হবে (হওয়াটা মোটেও অসম্ভব নয়, যদি দেশে চাষী না থাকে), তখন কী উপায় হবে! শিল্প-সাহিত্য-চেতনা-দেশপ্রেম তখন আমার কোন পিতৃপুরুষের ছেরাদ্দে লাগবে‌!

অতএব, বন্ধুগণ, ভাবুন। ভাবাটা জরুরী। বিপদটা আমার; কিন্তু আমার একলার না, সকলেরই। এই বাজার নামক দানবের যে জটিল অঙ্গসংস্থান, তার রূপটি সাধারণের কাছে তুলে ধরা দরকার। আমি গুণতে জানি না, খালি কম পড়লে টের পাই। সেই টেরটা পেয়ে যা বুঝেছি, তাই বললাম। যারা গুণতে জানেন তারা একটু গুণেটুনে বলুন। যারা অন্য আড্ডায় মশগুল, তারা একটু কান ফেরান, শুনুন। আপনাদের প্রতি গ্রাস ভাতের দোহাই, পাখি ও ফুল বিষয়ক আলোচনা মুলতুবি রেখে আপাতত ধানচাল বিষয়ে কথা বলুন। সুমনের যে গানটা দিয়ে শুরু করেছিলাম তারই শেষ লাইন কটা দিয়ে শেষ করি-

আমিও ভণ্ড অনেকের মত
গান দিয়ে ঢাকি জীবনের ক্ষত।
তবু বলি শোনো, দেখতে ভুলো না
অন্য ছবিও আঁকো!
অন্য ছবিও আঁকো!