মোদের গরব মোদের আশা

আমার দেশ নিয়ে একধরণের গর্ব আমার আছে। আমার দেশটি সুন্দর। অন্তত, সেইরকম ভাবতে আমি অভ্যস্ত। শৈশব থেকে দেশের বর্ণনায় নানা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলা হয়েছে। আমি তার কতক দেখেছি, কতক কল্পনা করে নিয়েছি। সুন্দরের সান্নিধ্যে একরকম গর্ববোধ হয়, যেমন গর্ববোধ হয় সুন্দর বন্ধু বা বন্ধুনীটি পাশে থাকলে। আমার দেশের ইতিহাস আমাকে গর্বিত করে। সে ইতিহাস সংগ্রামের। যখন বাংলাদেশ নামে কোনো দেশের কথা কেউ কল্পনাও করেনি, সেই সুদূর অতীত থেকে এই ভূখণ্ডের মানুষের লড়াই আমাকে মুগ্ধ করে। আমি সবচেয়ে মুগ্ধ হই আমার ভাষায়। অসীম শক্তিধর সংজননশীল একটি ভাষা। এ ভাষা একদিন বিশ্বজয় করবে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমার ভাষার জন্য আমি গর্ববোধ করি। আমি গর্ব করি এই ভাষায় রচিত সাহিত্যের জন্য। এই ভাষার কবিরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের কাতারে। এতজন শ্রেষ্ঠ কবি একটি ভাষায় না থাকলেও চলে। একটি ভাষার কবিতায় একজন রবীন্দ্রনাথ আর একজন জীবনানন্দই যথেষ্ঠ। আমি গর্ব করি বাংলার গান নিয়ে। গর্ব কবি জয়নুল আর সুলতানকে নিয়ে। গর্ব করি জগদীশ বসু আর প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে। গর্ব করি তেভাগার শহীদদের নিয়ে। গর্ব করি রফিক-সালাম-বরকতকে নিয়ে। গর্ব করি মোস্তফা-বাবুল-ওয়াজিউল্লাহকে নিয়ে। গর্ব করি আসাদকে নিয়ে, তিরিশ লাখ শহীদকে নিয়ে। গর্ব করি মতিউল-কাদেরকে নিয়ে। গর্ব করি নূর হোসেনকে নিয়ে, জাফর-জয়নাল-দীপালি-কাঞ্চনকে নিয়ে। আমার গর্বের শেষ নেই এই দেশ নিয়ে।

তবু, মাঝে মাঝে একটা শীতল স্রোত আমার মেরুদণ্ডের মজ্জার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আমি ভীত, সন্ত্রস্ত ও অসহায় বোধ করি। একদল বাঙালি সেটেলার শূকরবৎস দাঁত উঁচিয়ে পাক হানাদারের মত ছুটে যাচ্ছে অরণ্য ও পাহাড় ভেদ করে। হত্যা করছে, আগুন লাগাচ্ছে, লুটপাট করছে। আমারই মত কোনো বাঙালি পিতার বীর্যে কোনো বাঙালি মায়ের গর্ভে তাদের জন্ম। তারা আমারই ভাই, বন্ধু, স্বজন। তারা আমার লজ্জা। আমার এত যে গর্ব, তার সমস্ত দিয়ে এই লজ্জা আমি ঢাকতে পারব তো?!

জয়যাত্রা

গণতন্ত্র!!! গণতন্ত্রের আগে চাই প্রবৃদ্ধি। উন্নয়ন। দেশের মানুষকে আরো পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু হতে হবে। তৈরি পোষাক শিল্পে কিছু দুষ্কৃতি মাঝে মাঝে ঝামেলা করে। এদের দমন করতে হবে। তা না হলে বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি খারাপ হয়ে যাবে। শ্রমিকরা কষ্ট করছেন সে কথা সত্যি। কিন্তু তাদের কষ্ট বৃথা নয়। তারা উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। তারা আমাদের গর্ব। তাদের জন্য বিশ্বব্যাপী আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। নিজেদের একটু কষ্টভোগের চেয়ে দেশের ভাবমূর্তি অবশ্যই দামী। প্রতিবারের মত এবারও ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষক অবশ্য ধানের দাম ভাল পান নি, বাজারেও চালের দাম চড়াই আছে; কিন্তু তাতে কী! দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিছু ইনডিয়ান চাল আমদানি হয়েছে… আহা, দেশের ব্যবসায়ীদের স্বার্থটাও তো দেখতে হবে! সবচেয়ে বড় কথা, আমরা চাল রপ্তানি করছি! খুবই গর্বের বিষয়! চাল এখন শুধু আমাদের খাদ্যশষ্য মাত্র নয়, তা এখন রীতিমত অর্থকরী ফসল। দুষ্কৃতিদের কথায় কান দেবেন না। কৃষকরা আমাদের অন্নদাতা, ভগবান। তারা দেশের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারেন। সেইজন্যেই কবি বলেছেন, “সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা।” আহা! কী ভাষা! খাসা! দেশে এখনো বিদ্যুতের চরম ঘাটতি। পরমাণু শক্তিচালিত আধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশে তৈরি হবে। কী আনন্দের কথা। ‘পারমাণবিক’ শব্দটার মধ্যেই একটা থ্রিল আছে! একধরনের ঝুঁকিও আছে, কিন্তু উন্নয়নের খাতিরে সে ঝুঁকি জনগণকে মেনে নিতে হবে। সুন্দরবনের উপকণ্ঠে কয়লাভিত্তিক বিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে। দুষ্কৃতিরা পরিবেশ রক্ষার অজুহাতে তা বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করছে। আরে, দেশে উন্নয়ন না হলে সুন্দরবন ধুয়ে পানি খাবে পাবলিক? দেশ দুদ্দাড় বেগে এগিয়ে চলেছে ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সরকার বদ্ধপরিকর। কোনো দুষ্কৃতিই সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। হুঁ হুঁ একটা প্রেমপত্রও লিখতে পারবে না। একেই বলে, “দেখিয়াছ ঘুঘু, দেখনাই তার ফাঁদ!” উন্নয়নের বিরুদ্ধে সকল কণ্ঠ, সকল ষড়যন্ত্র দৃঢ়বলে রোধ করা হবে। উন্নয়নের মহাশকট অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা কোনোকিছুই তার গতি রোধ করতে পারবে না।

জয় হোক উন্নয়নের।

বড় হওয়া প্রসঙ্গে

আশৈশব গুরুজনেরা মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছেন, “বড় হও বাবা, মানুষ হও।” বাক্যের শেষ অংশটুকু বুঝতে বিশেষ কষ্ট হয়নি। খুবই স্পষ্ট। তারা চেয়েছেন, আমি যেন ন্যূনতম মানবিক গুণসম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠি। আমি যেন অমানুষ বা জালেম বা পিশাচ ইত্যাদি না হই। কিন্তু গোল বাঁধল প্রথম অংশ নিয়ে। ‘বড় হওয়া’ কথাটি দিয়ে আসলে মানুষ কী বোঝাতে চায়! তত্ত্ব-তালাশ করতে গিয়ে দেখলাম, কথাটা একটা বিরাট গোলকধাঁধা। ‘বড় হওয়া’ বিষয়টা একেকজন একেকরকম করে বোঝে। যেমন, কেউ বড় হওয়া বলতে বোঝে অনেক টাকাপয়সার মালিক হওয়া। তাঁদের মতে টাকা থাকলে দুনিয়ায় সব হয়। আবার, কেউ বড় হওয়া বলতে বড় প্রতিভাবান হওয়া বোঝে। অর্থাৎ, বড় শিক্ষক, বড় লেখক, বড় গায়ক, বড় আবৃত্তিকার, বড় অভিনেতা, বড় সাধুসন্ন্যাসী, বড় দার্শনিক ইত্যাদি। সবরকমের বড় হওয়াকে একটা সাধারণ সূত্রে আনতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছে। মোটা দাগে, বড় হওয়ার আসল মানে হলো গুরুত্বপূর্ণ হওয়া। যে কোনো উপায়ে সমাজে কেউকেটা হওয়া। কেউ কেউ বলেবেন- “এ তো খুবই স্বাভাবিক! এটা মানুষের প্রবৃত্তিগত ব্যাপার!” সবিনয়ে তাদের বলি, আমি তা মনে করি না। কেন? সেই কথাই পাড়ি ধীরেসুস্থে।
বড় হওয়ার দরকার কেন? সেটা কি বেশি ভোগের স্পৃহা থেকে উদ্ভূত? যদি তা হয়, সেই ভোগস্পৃহা কি স্বাভাবিক না আরোপিত? বড় হওয়ার প্রচলিত অর্থ অনুযায়ী সকল মানুষের কি বড় হওয়া সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তবে তার সুফল কারা ভোগ করে?
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে মানুষের উপরে মানুষের শোষণ বলবৎ থাকে। ফলে সমাজটা হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শত্রুতায় পূর্ণ। এ ধরণের সমাজে স্রেফ গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যও সংখ্যাগুরু মানুষকে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়। আর সংখ্যালঘু বিত্তবান অংশ সুখ-সাচ্ছন্দে জীবন অতিবাহিত করে। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে আরেক ধরণের লোক থাকে যারা ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’। তারা প্রচুর বিত্তশালী না, আবার হতদরিদ্রও না। এরা বিত্তবান সমাজের চুঁইয়ে পড়া উচ্ছিষ্টের সুফল ভোগ করে এবং শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ওই শ্রেণীভুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। চেষ্টা করে ‘বড়লোক’ হওয়ার। এই চেষ্টাটাকে তারা বলে ‘জীবনসংগ্রাম’, ‘স্ট্রাগল্’। এই স্ট্রাগলেরই অভীষ্ট হলো ‘বড় হওয়া’, যা কেউ কেউ হয়, অধিকাংশই হয় না। বড় হতে পারলে এক ধরণের সামাজিক মর্যাদা পাওয়া যায়, সেটা সমাজে এক ধরণের নিরাপত্তা। অধিকতর সুখ-সাচ্ছন্দে থাকা যায়। মোট কথা, ভোগের মাত্রা বহুগুণ বাড়ানো যায়। এখনকার প্রশ্নটি হলো এই অতিভোগের ইচ্ছা ‘কতখানি খাঁটি, আর কতখানি জল মেশানো’?
পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভোগের চ্যাপ্টারটা খুললেই দেখা যাবে লেখা আছে, “ভোগ একটি মানসিক ধারণা।” অর্থাৎ, সত্যিকার জৈবিক প্রয়োজন না থাকলেও মানুষ ভোগ করে। ভোগের পিছনে কিছু উদ্দীপনা কাজ করে। খেয়াল করে দেখবেন, সাবান, জুতো, টেলিভিশন, চিপস্, ক্রাকার্স ইত্যাদি জিনিসের কোম্পানিগুলো মাঝে মাঝে বিশেষ অফার দেয়। হালে সবচেয়ে বেশি অফার দেয় মোবাইল ফোন অপারেটররা। সব অফারের মূলকথা হলো অল্প টাকায় পণ্যটির বেশি একক কেনার সুযোগ। এটা একধরণের উদ্দীপক বা স্টিমুলি। এই স্টিমুলি দিয়ে মানুষের ভোগের আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে তোলা হয়। এই রকম অসংখ্য স্টিমুলি ব্যাবসাদাররা মানুষের উপর প্রয়োগ করে। কারণ, তাদের বেশি বেশি মাল বেচা দরকার। সমাজের মাতব্বর যখন ব্যবসাদাররা, তখন সেই সমাজের মূল উদ্দেশ্যই থাকে মাল বেচা ও পকেট ভরা। তাই, সেই সমাজের তাবৎ সংস্কৃতিক উপাদানও এই বেচাবিক্রির প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করে চলে। যা হাটে তোলা যায় না, তা এ সমাজে অচল। তাই, বড় হওয়ার ধারণাটিকে তারা শ্রেণী-নির্বিশেষে ছড়িয়ে দিতে চায়। কারণ, বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলে অনিবার্যভাবে ভোগের আকাঙ্ক্ষা বাড়বে। আর ভোগের আকাঙ্ক্ষা বাড়লে বেচাবিক্রি বাড়বে। বেচাবিক্রি বাড়লে অর্থাগম বেশি হবে।
গোটা ব্যাপারটা মোটেও এরকম সরল নয়। এটি একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ। পুরো প্রক্রিয়াটি ধরে রাখতে একটি বিরাট সমন্বিত কাঠামো গড়ে উঠেছে। একদিকে আছে শিক্ষা-ব্যবস্থা। যার দ্বারা এই ভোগের চক্র বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে টিকে থাকে। শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে ‘বড় হওয়ার’ ‘সুমহৎ’ আকাঙ্ক্ষাকে আরো জোরদার করে তোলা হয়। আরেকদিকে রয়েছে গণমাধ্যম, যা কিনা সাধারণের ভিতরে ভোগের ইচ্ছা উস্কে দেয়ার কাজটি জারি রাখে। তারা আমাদের শেখায়, মা সারাজীবন গরমে কষ্ট পেয়েছেন। মাতৃভক্ত সন্তান তাই অমুক কোম্পানির ফ্রিজ কিনে নৌকায় করে যাচ্ছে মায়ের কাছে। অতএব, অমুক কোম্পানির ফ্রিজ না হলে মায়ের মুখে হাসি ফুটবে না। তারা আরো শেখায়, অমুক ব্রান্ডের শিশুখাদ্য না খেলে আপনার সন্তান বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে বড় হবে। গরীব বাবার কালো-কুচ্ছিত মেয়ের বিয়ে হয় তমুক ব্রান্ডের ফেয়ারনেস ক্রিমের কল্যাণে। অমুক চিপস্ নাকি ‘দরজা বন্ধ করে একা একা’ খেতে হয়। তমুক বডি স্প্রে মাখলে পরকীয়ায় নাকি খুব সুবিধা হয়। আরো আরো বহু উদাহরণ দেয়া যাবে ইচ্ছে করলে। এমনকি, এসব কোম্পানির মুখে দেশপ্রেমের বুলিও আজকাল আমাদের শুনতে হয়। অর্থাৎ, মানুষের সকল ধরণের আবেগই এদের মাল বিক্রির হাতিয়ার এখন। আর এই অধিকতর মাল কিনতে পারার ক্ষমতা অর্জন করারই আরেক নাম বড় হওয়া।
‘বড় হওয়া’ শব্দবন্ধটির একরকমের ভ্রান্তি বা ইল্যুশন থাকে। আরো বেশি ইল্যুশন ও থ্রিল আছে স্ট্রাগল বা জীবনসংগ্রাম শব্দটার মধ্যে। আর ‘বড় হওয়ার জন্য স্ট্রাগল করা’ এই শব্দগুচ্ছটি যে মাত্রার ইল্যুশন তৈরি করে তা তুলনাহীন। এতক্ষণ যে মাল বেচাবিক্রির নগ্ন স্বার্থের কথা বলালাম তার গোটাটাকেই ব্যক্তিমানসে একটা মহত্বের চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া চলে কেবল এই শব্দগুচ্ছ দিয়ে।
এইখানে থেমে আবার একটু পিছনে ফেরা দরকার। ধরুন, একটি ছেলে। বাপ নেই, বড় সংসার। বড় ভাইটি অল্প উপার্জন করে। ছেলেটি পড়াশুনা করছে। তাকে বড় হতে হবে। পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে হবে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে বড় হওয়ার। এবার তার ঘর থেকে বেরিয়ে ওইরকম আরেকটি ঘরে ঢুকুন। দেখবেন একই চিত্র। বাংলাদেশের, সারাবিশ্বের, লাখ লাখ, কোটি কোটি পরিবারের একই দৃশ্য। সবাই বড় হতে চাইছে। বড় কিন্তু খুব অল্প লোকেই হবে। কেননা সবাই বড় হয়ে গেলে কারোরই আর বড় হওয়ার দরকার থাকবে না। বড় হওয়ার দরকার আছে, কেননা একদলের অঢেল আছে, আরেক দলের কিচ্ছু নেই গতর ছাড়া। একদল গতর খাটিয়ে খায়, আরেকদল গতর পুষে চলে। এই ভেদ দুনিয়াতে আছে বলেই মানুষের বড় হওয়ার দরকার পড়ে। ব্যক্তির কাছে এই বড় হওয়া দরকারি হতে পারে, কিন্তু মহৎ নয় আদৌ। এমনকি, দৃষ্টিটা আমরা যতই প্রসারিত করব, ততই বড় হওয়ার ধারণাটির অসারত্ব ধরা পড়বে। ততই, আমারা বুঝতে পারব ‘বড় হওয়ার স্ট্রাগল’টা আসলে একটা জুয়াখেলা। এবং চূড়ান্তরকমের অমানবিক জুয়া। এ যেন সেই গাধার নাকের সামনে ঝুলানো মুলোর মত (খুবই পুরোনো কিন্তু সবচেয়ে সঠিক উপমা)। এই বড় হওয়ার প্রক্রিয়া সমাজে চালু থাকলে কারবারী লোকের নানানরকম সুবিধা। বেচাবিক্রির কথাটা আগেই বলেছি, তারও চেয়ে বড় একটি সুবিধা আছে। সংখ্যাগুরু মানুষ এবং বিশেষ করে যারা তাদের মধ্যে আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ পেয়েছে, তারা এই জুয়াখেলায় মত্ত থাকে। এই জুয়ার নেশা তাদের ভুলিয়ে দেয়, মানুষের দুর্দশার মূল কারণ ও তার সমাধানসূত্র ব্যক্তিপর্যায়ের ব্যাপার না। মূল গলৎটি সমাজের অর্থনীতির কেন্দ্রে। ব্যবস্থাটি না বদলালে এই হারাজেতার খেলাই চলতে থাকবে, বহুতর মানুষের ভাগ্যের কোনো উন্নতি ঘটবে না।
এই বোধহীনতা এই সমাজ টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় অস্ত্রগুলোর একটি। তাই এই সমাজে ‘বড় হওয়ার সংগ্রাম’ খুবই মহৎ আর মানবমুক্তির সংগ্রাম খুবই ‘বিপজ্জনক’।
এইবারে আবার গোড়ার কথাটায় যাই। প্রহসনটি হলো, ‘বড় হওয়া’ আর ‘মানুষ হওয়া’ একই সাথে সম্ভব কিনা। মানুষ হওয়ার অর্থ যদি সৎ, নির্ভীক, সত্যবাদী, মানবপ্রেমী, পরিবেশ সচেতন ইত্যাদি মানবিক গুণসম্পন্ন হওয়া বোঝায় তবে বড় হওয়া তার আর হয়ে ওঠে না। কেউ তর্কের খাতিরে বলতে পারেন, “আহা! ওসব বাদ দাও। ‘বড় হওয়া’ বলতে তো ‘বড় মানুষ হওয়া’ও বোঝানো যেতে পারে।” এইবার আসলে অট্টহাসির সময়। ঠিকঠাক মানুষ হতে পারলে আবার আলাদা করে বড় মানুষ হওয়ার কী প্রয়োজন, সেটাই আরেকটা রহস্য!

আমি এক যক্ষ মহানগরীর...

আজকে আড্ডায় বসে হঠাৎ এক স্মৃতিকাতরতায় পেয়ে বসল। প্রসঙ্গ ভূপেন হাজারিকার গান। মনে পড়ে গেল এক স্পিকারের প্যানাসনিক ক্যাসেট। সে কবেকার কথা! প্রথম কৈশোরের শেষভাগ। সমস্তদিন ফাঁকে ফাঁকে ভূপেন হাজারিকার গান। ‘মানুষ মানুষের জন্যে’। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বারবার শোনা। জাপানি টিডিকে ক্যাসেটে যত্নে রেকর্ড করা সব গান। একটা রেকর্ডিং-এর দোকান ছিল, প্রথমে নিউমার্কেটে, অনেক পরে বায়তুন-নূর মসজিদের তলায়। শালা দুলাভাই মিলে চালাত সেই দোকান। দুলাভাই লোকটির নাম ছিল মোদাচ্ছের। আমরা তাঁকে বলতাম বাংলা গানের মাস্টার। যেমন বিশাল তাঁর সংগ্রহ, তেমনি অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি। হাজার হাজার গানের সুরকার, গীতিকার ও শিল্পীর নাম ছিল তাঁর নখদর্পনে। গান শোনার নেশায় পেয়েছিল অল্প বয়সেই। গোঁফের রেখা দেখা দেবার আগে থেকেই, অতি কষ্টে জমানো মূদ্রা কয়টি পকেটে নিয়ে, সাইকেল চেপে যেতাম গান তুলতে। নানারকম গানের দিকে আগ্রহ দেখে মোদচ্ছের কাকা আমাকে খুবই ভালবাসতেন। প্রতি ক্যাসেটে পাঁচ টাকা ছাড় ছিল আমার জন্য। ৬০মিনিটের একটা জাপানি টিডিকের দাম ছিল ৪৫ টাকা। আর রেকর্ডিং ফি ২০ টাকা। কাকা সব মিলিয়ে ৬০ টাকা রাখতেন। তাও সবসময় পকেটে থাকত না। কখনো ৫-১০ টাকা বাকি রেখে আসতাম। তা আবার তিনি ইচ্ছে করেই ভুলে যেতেন। যদি জিগ্যেস করতাম, “কাকা, আগের কয়ডা টাকা পাতেন না আমার কাছে?” তিনি থুতনির একগোছা দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে মনে করার ভঙ্গিতে বলতেন,”তা তো মনে হয় পাতাম কাকা, কিন্তু কয়টাকা মনে-টনে নেই। যাক, তুমি তার চেয়ে আমারে এট্টা নেভি সিগারেট খাওয়ায়ে দাও, তালিই হবেনে।” বলে অতিরহস্যময় স্নেমিশ্রিত একটা হাসি দিতেন। সেই লোকটা, এক প্রকার বাড়ির পাশের লোকটা দুম করে একদিন মরে গেল, আমি খোঁজও রাখিনি। হঠাৎ হঠাৎ সেই শীর্ণদেহি বৃদ্ধকে মনে পড়ে ঝপ করে চোখে জল চলে আসে।

যা হোক, বলছিলাম ভূপেনের গানের কথা। সেই কিশোর মনে গানগুলো এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল, যাকে বলে একেবারে ‘রিড অনলি মেমরি’ হয়ে গেছে। চোখ ছল ছল করে, বেহুলা বাংলা, গঙ্গা আমার মা, বিস্তীর্ণ দুপাড়ে, সাগর সঙ্গমে, আমি এক যাযাবর, শীতের শিশিরে ভেজা, দোলা, একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে– এরকম আরো কত কত গান। ওহ হো, তারপর ওই গানগুলো! জীবন খুঁজে পাবি, ধমধমাধম ধমধমাধম জীবন মাদল বাজে, শারদীয় শিশিরে– আহা কী সব গান। ইচ্ছে করে একেকটা গান নিয়ে আলাদা করে বলি। আমার তাতে ক্লান্তি হবে না একটুও, কিন্তু এই ছোট লেখাটি যারা দয়া করে পড়ছেন, তাদের ধৈর্য্যের বিরাট পরীক্ষা হয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি অতএব, দুটো গানের কথা বিশেষ করে বলতে চাই। একটা হলো আমি- আমি এক যাযাবর। বুঝতে শেখার আগে থেকেই এই গানটা কেন যেন আমায় টানত। পরে বুঝেছি এই গানটার মধ্যে একরকমের আন্তর্জাতিকতা আছে। শুনলেই এক যাযাবর বিশ্বনাগরিকের ছবি ভেসে ওঠে মনে। সকল দেশের সকল মানুষের সাথে একধরণের আত্মীয়তা অনুভব করি মনে মনে। লিরিকটা খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, এ গানটা একেবারেই অন্য জাতের। “আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমারে আপন করেছে, ছেড়েছি সুখের ঘর॥” প্রথমেই দেশ-জাতির গণ্ডি ভাঙার ঘোষণা। তারপর সেই অদ্ভূত লাইনগুলো–
আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভোলগার মুখ দেখেছি
আমি অটোয়ার থেকে অস্ট্রিয়া হয়ে প্যারিসের ধূলো মেখেছি
আমি ইলোরার থেকে রঙ নিয়ে দূরে শিকাগো শহরে দিয়েছি
আমি গালিবের শের তাশখন্দের মিনারে বসে শুনেছি
আমি মার্কটোয়েনের সমাধিতে বসে বর্গীর কথা বলেছি…

শুনতে শুনতে মনটা দেহের খাঁচা ছেড়ে সেসব অচিন জায়গার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। তার পরের লাইনগুলোতেই ফুটে ওঠে আরেক চিত্র। শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনার।
বহু যাযাবর লক্ষ্যবিহীন, আমার রয়েছে পণ
রঙের খনি যেখানে দেখেছি রাঙিয়ে নিয়েছি মন
আমি দেখেছি অনের গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি
তার ছায়াতেই দেখেছি অনেক গৃহহীন নরনারী
আমি দেখেছি অনেক গোলাপ-বকুল ফুটে আছে থরে থরে
আবার, দেখেছি না-ফোটা ফুলের কলিরা ঝরে গেছে অনাদরে
প্রেমহীন ভালবাসা দেশে দেশে ভেঙেছে সুখের ঘর…

সেই অল্প বয়সে পৃথিবীব্যাপী বৈষম্যের এই সহজ চিত্র মনে কীরকম দাগ কেটেছিল তা বুঝতেই পারছেন। সেই ঘোর থেকে আজো বেরোতে পারিনি।

আরেকটা গানের কথা বলি। এ গানটা ভাললাগার তালিকায় যুক্ত হয়েছে অনেক পরে এসে। যখনকার কথা এতক্ষণ বলেছি তখনি নয়। এ গানটা একটা রোমান্টিক গান। একখান মেঘ ভেসে এল আকাশে। গোড়াতে এ গান আমার একদম ভাল লাগত না। (তখন অবশ্য কোনো রোমান্টিক গানই ভাল্লাগতো না। মাথায় একধরণের এন্টি-রোমান্টিসিজম ভর করেছিল।) এই গানের দুটি লাইন আছে, যে কারণে বড় হবার পরে গানটি মনে গেঁথে গেছে। লাইন দুটি হলো-
আমি এক যক্ষ মহানগরীর
যারে ডাকি কেন তার পাই না সাড়া..

তা, ছোটবেলায় কালিদাসস্য মেঘদূতম্ তো আর পড়ে পারিনি! বিরহী যক্ষের মর্ম কী করে বুঝব! সে বোঝার বয়সও তখন হয় নি। তার উপর সে যক্ষ যদি হয় নাগরিক যক্ষ, বাপরে বাপ! ফারুখ ভাই দারুণ বলেছেন। “যক্ষ কী বস্তু যদি না জানো, তবে ওই হাহাকার কী করে বুঝবে!” যা হোক, এ গান, বলা ভাল এই দুটি লাইন যতবার যতবার শুনি ততবার ততবারই বুকের মধ্যে যে তীব্র হাহাকার তৈরি হয় তা বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নেই। আজো আনন্দ-বিষাদে নাগরিক একাকিত্বে এই দুটি লাইন বারংবার ঘুরেফিরে মনে আসে–
আমি এক যক্ষ মহানগরীর
যারে ডাকি কেন তার পাই না সাড়া
চোখে তাই ঝরঝর বৃষ্টিধারা….

রেন্টু ভাই

আজ সকাল থেকে একটা লোকের মুখ থেকে থেকে মনে পড়ছে। নামজাদা কেউ নয়। তিনি একজন কবি ছিলেন। এই শহরের এক ঘিঞ্জি এলাকার তস্য গলিতে তাঁর জীবন কেটেছে। হতচ্ছাড়া স্মৃতি আজ তাকেই কেন খুঁড়ে বের করলো কে জানে! আসলে তাঁর লেখা কবিতার একটা লাইন ঝট করে চলে আসল মাথার মধ্যে। তারপর স্মৃতির ম্যাগনেটিক টেপ সাঁই সাঁই করে রিওয়াইন্ড করে একটা জায়গা থেকে আবার চলতে শুরু করল। সালটা ২০০৭। আমি তখন বইমেলার সাথে সদ্য যুক্ত হয়েছি। সাত, আট, নয় তিনটে বছর ফেব্রুয়ারি এলে বইমেলাই ধ্যানজ্ঞান। অনেকের কথাই মনে পড়ে, সক্কলের কথা আপাতত মুলতুবি থাক, অন্যত্র বলা যাবে। রাত বারোটার আগে বাড়ি ফেরা হতো না একদিনও। সারাদিন মেলায় অর্ধভুক্ত-অভুক্ত থেকে খাটাখাটনি আর গেলাস গেলাস চা। আর দিনভর পেটভরে আড্ডা দিয়ে একপেট এসিড নিয়ে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরা। সেই ফেরার কয়েকজন সঙ্গী ছিল। কবি মশিরুজ্জামান, বন্ধু সুলতান মাহমুদ রতন, বন্ধু রাসেল মাহমুদ, শ্রাবণ ভাই আর রেন্টু ভাই— মীর আব্দুল জব্বার রেন্টু। এরা আর সকলেই কবি গোত্রের, আমিই একমাত্র অকবি। এদের সকলেই সবদিন থাকতেন না। আমি, মশিরুজ্জামান আর রেন্টু ভাই প্রতিদিনই একসাথে ফেরা হতো। মধ্যরাতে কখনো ফেরার পথে আরো একদফা আড্ডা হতো। মশিরুজ্জামানকে বাড়ি পৌঁছে দিতে আমরা বাকি দুজন হেঁটে যেতাম তাঁর সাথে, আবার আমাদের এগিয়ে দেয়ার ছুতোয় তিনিও ফের উল্টোদিকে হাঁটতেন। তখনই এই রেন্টু ভাইর সাথে অন্তরঙ্গতা বাড়তে থাকে। সারাদিনের কবি মানুষটির ভিতর থেকে আরো একটি মানুষ বেরিয়ে আসত তখন। তার সংসার আছে, সন্তান আছে, সে সংসারে চূড়ান্ত অনটন আছে— মানুষটি ধীরে ধীরে একেবারে নিজের মানুষ হয়ে গেল কখন, ঠিক ঠাহর করতে পারি নি। সেই মধ্যরাতে তাঁর দীর্ঘশ্বাস কানে ধরা পড়তো। নিজেরই একটা কবিতার লাইন বারবার করে বলতেন— আমি পড়ে আছি খুউব দক্ষিণে একা। সেই মানুষটি, সেই কাছের মানুষটি হঠাৎ একদিন দুম করে ট্রেনের মধ্যে হার্ট এটাকে মরে পড়ে থাকল। আর এমনই অধম আমি, সে দিনটিও আজ স্মরণ করতে পারি না। কিন্তু আজ সকালে, কবিতার এই লাইনটি মনে পড়ে, তারে সাথে তাঁর মুখটি মনে পড়ে থেকে থেকে চোখ ছলছল করে উঠছে। একটি পান খাওয়া বকবকে আড্ডাবাজ মুখ মনের মধ্যে জীবন্ত হয়ে উঠছে। কিছু ছেঁড়াখোঁড়া মানুষ, সহজ কিন্তু প্রাণবন্ত তারা আমার আজকের দিনের দৈন্যকে আরো প্রকট করে তুলছে। চারপাশে তাকালে আজ বুঝতে পারি একটি একটি করে মানুষ তাদের জীবনের পসরা গুটিয়ে নিচ্ছে। আমি ক্রমশ এই দক্ষিণে আরো একা হয়ে পড়ছি। যাহোক এই কবি আব্দুল জব্বার রেন্টু, আমাদের রেন্টু ভাই, তাকে কবি বলে খুব একটা মান্যিগণ্যি কোনোদিন করিনি, কিন্তু তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, সুজন ছিলে, আমাকে ভালবাসতেন। যে কবিতাটির জন্য আজ সারাদিন আমার এ দুর্ভোগ, সেটি তুলে দিলাম। বন্ধু রতনকে ধন্যবাদ কবিতাটির ছবি তুলে পাঠানোর জন্য (আবারও ভাবি, কী নির্দয় অকৃতজ্ঞ আমি! তাঁর একখানি বই ভালবেসে দিয়েছিলেন আমাকে, হারিয়ে ফেলেছি।)

আমি প’ড়ে আছি খুউব দক্ষিণে একা
কোথাও কোনো শব্দ নেই,
অথচ কোত্থেকে একঝাঁক বরফ হঠাৎ উড়ে এসে
জুড়ে বসে—
হয়ে যায় লৌকিক নিসর্গ নান্দিক কবিতা।

যেমন সলোমান তাঁর সম্রাজ্ঞী শেবাসহ
দরবার সিংহাসন কুরছি নিয়ে উড়ে যান
উড়ুক্কু যানে,
তেমনি আমার ভেতরে ডোরবেলে কে যেন চাপ দেয়-
কে ডাকে এই মধ্যযামে?
শরতে সাঁইজির স্পষ্ট আন্ধার ফুঁড়ে
ছুটে যায় দ্রুত মনোরেল নগর বিহঙ্গমা;
শুধু আমি পড়ে আছি খুউব দক্ষিণে একা
নগরের উল্টোপথে আঠারোবেঁকির চর হতে
ধবধবে-শাদা-বক শব্দগুলো ডিগবাজি খেয়ে নেমে আসে
কবিতার সমগ্র জলজমিনে,
এই শরতে বাইজির শাদা-শাদা রূপারাতে

হে শরৎনারী, এই অন্ধকার রাতে
তোমার পীনোন্নত ব্রা এবং নিতম্ব ছুঁয়ে ছুঁয়ে
ভেসে যাচ্ছে কোথায় নিজল শাদা মেঘ প্রেম—
কোন সে ডেরায় পরকীয়া সোহেলীর পথে?
আর আমি শুধু পড়ে আছি খুউব দক্ষিণে একা
একা।