ব্রাহ্মী শাক

তেলাকুচ-Coccinia grandisশিল্পীরা বড় বড় ওস্তাদের নাম নেয়ার সময়, তাদের গান গাইবার সময় কানে হাত ছোঁয়ান। যেমন, কোনো শিল্পী যদি মিঞা-কি-মল্লার গান, তবে আগে কানে হাত ছুঁইয়ে নেন। এটা একপ্রকার বিনয় প্রকাশ- “যে গান ওস্তাদের ওস্তাদ মিঞা তানসেন সৃষ্টি করেছেন, গেয়েছেন; তা আমি গাওয়ার দুঃসাহস করছি।” আমিও তেমনি কোনো প্রসঙ্গে আমার ওস্তাদ সৈয়দ মুজতবা আলীর নাম নিলে কানে হাত ছোঁয়াই- যে বিষয়ে রসরাজ সৈয়দ মুজতবা আলী লিখে গেছেন সে বিষয়ে আমিও ক্বচিৎ-কদাচিৎ দু-এক বাক্য লিখবার দুঃসাহস করি।

ওস্তাদ বলেন, খাদ্যবীণার ছয়টি তার। তাঁর লেখায় অবশ্য টক, ঝাল, মিষ্টি, তিতে ও নোনতা স্বাদের উল্লেখ পাই। ষষ্ঠ তারটি যে কী, তা তিনি লিখে যান নি। আমি হিসেব করে দেখলাম ষষ্ঠ তারটি হলো কটু বা কষ্টা স্বাদ। এই ছয়টি তারের মধ্যে পূর্ববাংলা, মানে বাংলাদেশের রান্নায় তিনটি স্বর মূখ্য- টক, ঝাল, তিতে। ওস্তাদ লিখব লিখব করেও বাঙালী রসনা নিয়ে বিশেষ কিছু লেখেন নি, যত লিখেছেন মোগলাই রান্না নিয়ে। বোধকরি দীর্ঘকাল পূর্ববাংলার বাইরে শান্তিনিকেতনে ও ততঃপর নানা প্রবাসে থাকায় এ বিষয়ে তাঁর আর লেখা হয়ে ওঠে নি। বিপরীতক্রমে, আমি খাঁটি চাঁড়াল বংশোদ্ভূত, নিজের এলাকার বাইরে জগৎ আছে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, বদহজমের ভয়ে মোগলাই রান্না বেশি খেতে সাহস করি না, বরং এই বাংলার চাষাভুষোর রান্নাই আমার প্রধান খাদ্য। তাই বাংলার রসনা নিয়ে একান্তই নিজের অভিজ্ঞতার উপরে ভর করে দু-চারটি কথা মাঝে মাঝে বলার চেষ্টা করি।

পদ্মার ভাটিতে গড়ে ওঠা ভূমির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এ অঞ্চলে যে বহুল প্রকারের শাকপাতা আপনাআপনি জন্মে তা দুনিয়ার আর কোথাও জন্মায় কিনা আমার জানা নেই। তাই শাকপাতা খাওয়ার ব্যাপারে এতদঞ্চলের মানুষের (বিশেষত তাদের যারা খুব বেশি ভদ্দরলোক নন) অভ্যাস বাংলাদেশের আর কারো সাথে মেলে না। হেলঞ্চ, মালঞ্চ, নটে, কাঁটানটে, ছেঁচি, ভাইতো, কলমি, আমরুলি, থানকুনি, গিমি, ব্রাহ্মী, কাঁথাছেড়া বা কাঁথাবুচুড়ে, হরেকরকম কচুশাক– এরকম অজস্র প্রকারের শাক এ তল্লাটে আপনিই জন্মায়। চাষফাষ বিশেষ করা লাগে না। প্রত্যেকটি শাকের আবার একাধিক জাতও আছে। তাদের মধ্যে রয়েছে স্বাদের অতিসূক্ষ্ম তারতম্য।

যা হোক, এতখানি ভূমিকা করলাম যে জন্যে সেইটে এবার বলে ফেলি। আজকে দুপুর রোদে বাড়ি ফিরে গরমে কাহিল অবস্থা। খিদেয় মাথা ভোঁ ভোঁ করছে, অথচ মুখে রুচি নেই একটুও। খেতে বসে জানে পানি পেলাম। ব্রাহ্মী শাক! শাকমাত্রই আমার প্রিয় বস্তু। তবে এ শাকটি একটু বেশিই প্রিয়। রুচি উৎপাদনে এর তুলনা হয় না। ভাজা ব্রাহ্মী শাক থেকে একপ্রকার ঘিয়ের মত সুঘ্রাণ বের হয়। শাকটি তিতে গোত্রভুক্ত। কবিরাজরা বলেন এই শাকে নাকি স্মৃতিশক্তি বাড়ে। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমি অবশ্য পাই নি। কারণ, ছোটবেলা থেকেই এ শাক আমি খাই, কিন্তু আজ পর্যন্ত পরীক্ষার খাতায় একটি প্রশ্নের উত্তরও আমি হুবহু মুখস্ত লিখতে পারি নি। ভুলে যাওয়ার ব্যাপারে আমার দক্ষতা বন্ধুজনের কাছে অবিদিত নয়। তবে খেতে ভালো এবং রুচিকর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করে বাঁচতে গিয়ে বহুরকম পুষ্টি উপাদানও এই বিরুৎ তার দেহে সঞ্চয় করে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, এক্কেবারে মুফতে, মানে মাগনা পাওয়া যায়। একটি পয়সা খরচ করতে হয় না ব্রাহ্মী শাক জোগাড় করার জন্য। আর কী চাই!