তারে কয় প্রেম

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে প্রেম শব্দটির ডজনখানেকের বেশি অর্থ দেয়া আছে। সেগুলো যথাক্রমে- প্রিয়ভাব, সৌহার্দ্দ, স্নেহ, ভালবাসা, ভ্রাতৃবাৎসল্য, যুবক-যুবতীর ধ্বংসরহিত ভাববন্ধন, অনুরাগ, প্রণয়, বিয়োগাসহিষ্ণুতা (বিয়োগ+অসহিষ্ণুতা), হর্ষ, নর্ম্ম, কৃষ্ণের ইন্দ্রিয়প্রীতির ইচ্ছা, গাঢ় রতি বা অনুরাগ।

শব্দটির ব্যুৎপত্তি নির্দেশ করা আছে- প্রিয়+ইমন্। অর্থাৎ প্রিয়ভাব। প্রিয় শব্দটি আবার তৈরী হয়েছে প্রী ধাতু অ প্রত্যয় যোগে (√প্রী+অ)। প্রী ধাতুর অর্থ দেয়া আছে প্রীতি বা প্রীতিভাব। প্রিয় শব্দটির আবার গোটা আষ্টেক মানে। প্রীণয়িতা, অভীষ্ট, দয়িত, বল্লভ, অভিমত, প্রীতিকর, সহজপ্রীতিমান্, অনুরাগী প্রভৃতি।

এখন শব্দটিকে কলিম খান নির্দেশিত বর্ণভিত্তিক-ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে ফেলা যাক। মূল ধাতুটি প্রী। অর্থাৎ, প্+র্+ঈ। প্ = পালন-পান-প্রাপণ, র্ = রহন-ভক্ষণ-রক্ষণ ও ঈ = সক্রিয়। পালন রহন/রক্ষণ সক্রিয়। এর সাথে আছে অ প্রত্যয়। অ = অস্তিত্বন। সাকুল্যে প্রিয় (√প্রী+অ) কথাটির মানে দাঁড়ায় যে অস্তিত্বে পালন সক্রিয় থাকে (রহন=থাকা)। আবার আমরা এও বলতে পারি পালন-রক্ষণ (পালন করা ও রক্ষা করা) উভয়ই সক্রিয় যে অস্তিত্বে তাই ‘প্রিয়’। এবার আসি ইমন্ প্রত্যয়ে। ই+ম্+অ+ন্। ই = সক্রিয়ন, ম্ = সীমায়ন। আর অন্ দ্বারা চলিষ্ণু ঘটনার নাম ব‌োঝায়। চলন, বলন, কথন ইত্যাদি। কেন এমন হয়? কলিম খানের মতটি হলো, অ = অস্তিত্বন ও ন্ = নাকরণ-অনকরণ। অনবচ্ছিন্ন অস্তিত্বের নেতিকরণ করেলই তাকে গতিলশীল করা হয়। যেমন ধরা যাক, একটা ফুটবল। দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। নড়ছে-চড়ছে না। দিলাম এক লাথি। ধাঁ বেগে ছুটে গেল। যখন সে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন ছিল একটি অনবচ্ছিন্ন সাম্যের মধ্যে। মহাবিজ্ঞানী নিউটন একে বললেন জড়তা। বলপ্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির ও চলমান বস্তু চলমান থাকবে। সেই সাম্যভঙ্গ হলেই বলটি চলিষ্ণু হলো। তখন তার নড়ন(নড়্-অন্)-চড়ন(চড়্-অন) ঘটে। অতএব, ইমন্ হলো কোনো আধারে (সীমায়) ক্রিয়ার সক্রিয় ভাব। তাই প্রেম প্রিয়তার একটি বন্ধন বা আধার। এমনই বন্ধন যা পালন-রক্ষণে সক্রিয় থাকে। তা সক্রিয় থাকে নিরন্তর ‘অন্’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ অজস্র নেতির নেতিকরণের মধ্য দিয়েই প্রেম টিকে থাকে।

এখন, দেখতে হবে প্রেম শব্দটি যতক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, সর্বত্র এই সূত্র মেনে চলে কিনা। কবিগুরু বলেছেন, ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে’। যথার্থ কথা। দুনিয়াতে প্রেমের রূপ ও বৈচিত্র্যের অন্ত নেই। মরমী কবি বিজয় সরকার যেমন ঈশ্বর বিষয়ে বলেন, ‘বহুনামে ধরাধামে কত রঙ্গ যে দেখি!’ তেমনই বিচিত্র রঙ্গে লীলাময় প্রেম। নর-নারীর প্রেম, দেশপ্রেম, পরকীয়া প্রেম, কৃষ্ণপ্রেম, বন্ধুপ্রেম, বাৎসল্যপ্রেম, বইপ্রেম, ক্রীড়াপ্রেম, পশুপ্রেম, বৃক্ষপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম; যেদিকে তাকাই শুধু প্রেম আর প্রেম। দেখা দরকার, আমরা ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে যে শব্দার্থ নিষ্কাশন করেছি তা এই সকল প্রেমের ক্ষেত্রে ন্যূনতম শর্ত হিসেবে কাজ করে কিনা। আমি প্রয়োগ করে দেখেছি কাজ করে। সকল প্রেমের তত্ত্বতালাশ এ স্থলে বাঞ্ছনীয় নয়। অতএব হাঁড়ির দু একটি ভাত টিপে দেখা যাক।

ধরা যাক, দেশপ্রেম। ‘দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না’, বলেন রবীন্দ্রনাথ (এই হয়েছে এক জ্বালা। এই বুড়োকে বাদ দিকে কিছুই গুছিয়ে বলবার জো নেই!)। দেশপ্রেমের প্রশ্ন আসলেই তাকে রক্ষা করার প্রশ্ন আসে। দেশে সকল শুভ সম্ভাবনাকে পালন করে বিকশিত করার প্রশ্ন আসে। তা করতে গিয়ে অসংখ্য নেতির সাথে লড়াই করা প্রশ্ন আসে। অতএব পালন-রক্ষণার্থ নেতির বা অশুভের বা বাধা-বিপত্তির সাথে লড়াই দেশপ্রেমের একটি শর্ত।

আবার ধরুন আপনি বইপ্রেমী লোক। আপনাকে বইয়ের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তা করতে হবে পোকামাকড়, আর্দ্রতা ইত্যদির সাথে লড়াই করেই। কিম্বা আপনি বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। আজ যে মহীরুহ চারা তাকে ছাগলে যাতে না মুড়োয় সেই ব্যবস্থাটি করাই তো আপনার প্রেমের প্রকাশ। অথবা, বন্ধুপ্রেমের কথাই ধরুন। বন্ধু বিপদে পড়লে আপনি নিশ্চয়ই তাকে রক্ষা করেন। ছাত্রাবস্থায় দরিদ্র প্রিয় বন্ধুটির পালনের ভারও নিয়েছেন নিশ্চয়ই। ঝগড়া-বিবাদ, মান-অভিমান নিশ্চয়ই হয়েছে। সেগুলোর নেতিকরণ অর্থাৎ সমাধান করেই বন্ধুত্ব অগ্রসর হয়েছে।

ভাতে উতোল এসে গেলো। আরেকটি চাল পরীক্ষা করি এবার। যুবক-যুবতীর ধ্বংসরহিত ভাববন্ধন। নরনারীর এমন প্রেম খুঁজে পাওয়া বিরল যা কিনা অসংখ্য প্রকার বাধাবিপত্তি মোকাবেলা করে অগ্রসর হয় নি (দু-একটি নিপাতনে সিদ্ধ ব্যতিক্রম থাকতে পারে)। কত না কাব্যকাহিনি, উপন্যাস, নাটক নির্মিত হয়েছে কেবল নরনারীর প্রেম নিয়ে। লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট, রাধা-কৃষ্ণ আরো কত! কখনো প্রেমিকা সংকল্পবদ্ধ- ভয়বাধা সব অভয়মূর্তি ধরি পন্থ দেখায়ব মোর। কখনো লাইলির খোঁজে মজনু পাগলপারা। মরুপথে ক্যারাভান থেকে ক্যারাভানে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার জান-ই-মন-এর দিশা। অথবা জুলিয়েটের আর্তি - “O Romeo, Romeo, wherefore art thou Romeo? Deny thy father and refuse thy name…”। সব প্রেমিকযুগলই পালন করে কিছু সংকল্প, স্বপ্ন ও আকাঙ্খা। পরস্পরকে রক্ষা করতে চায়, এমনকি জীবনের বিনিময়ে। সে সব আমরা সিনেমাতেও দেখি হামেশাই। আক্রান্ত নায়িকাকে রক্ষা করছে নায়ক অথবা নায়িকা দরিদ্র নায়ককে রক্ষা করছে তার দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্ষমতাবান পিতা ‘চৌধুরী সাহেবের’ রোষ থেকে।

অতএব, এ পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে দেশপ্রেমই হোক আর লাইলি-মজনুর প্রেমই হোক, প্রেম হতে হলে বা প্রেম করতে হলে দুটো শর্ত মানতে হবে। এক, সম্পর্কটির আধারে বহুবিধ বিষয় পালন ও রক্ষণ করতে হবে। দুই, তা করতে গিয়ে বহু রকমের নেতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। নইলে পাশ্চাত্যের অনুকরণে উপরিভাসা কিছু একটা হবে বটে, কিন্তু তা বাংলা ব্যুৎপত্তি সিদ্ধার্থ প্রেম হবে না।