বড় হওয়া প্রসঙ্গে

আশৈশব গুরুজনেরা মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছেন, “বড় হও বাবা, মানুষ হও।” বাক্যের শেষ অংশটুকু বুঝতে বিশেষ কষ্ট হয়নি। খুবই স্পষ্ট। তারা চেয়েছেন, আমি যেন ন্যূনতম মানবিক গুণসম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠি। আমি যেন অমানুষ বা জালেম বা পিশাচ ইত্যাদি না হই। কিন্তু গোল বাঁধল প্রথম অংশ নিয়ে। ‘বড় হওয়া’ কথাটি দিয়ে আসলে মানুষ কী বোঝাতে চায়! তত্ত্ব-তালাশ করতে গিয়ে দেখলাম, কথাটা একটা বিরাট গোলকধাঁধা। ‘বড় হওয়া’ বিষয়টা একেকজন একেকরকম করে বোঝে। যেমন, কেউ বড় হওয়া বলতে বোঝে অনেক টাকাপয়সার মালিক হওয়া। তাঁদের মতে টাকা থাকলে দুনিয়ায় সব হয়। আবার, কেউ বড় হওয়া বলতে বড় প্রতিভাবান হওয়া বোঝে। অর্থাৎ, বড় শিক্ষক, বড় লেখক, বড় গায়ক, বড় আবৃত্তিকার, বড় অভিনেতা, বড় সাধুসন্ন্যাসী, বড় দার্শনিক ইত্যাদি। সবরকমের বড় হওয়াকে একটা সাধারণ সূত্রে আনতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছে। মোটা দাগে, বড় হওয়ার আসল মানে হলো গুরুত্বপূর্ণ হওয়া। যে কোনো উপায়ে সমাজে কেউকেটা হওয়া। কেউ কেউ বলেবেন- “এ তো খুবই স্বাভাবিক! এটা মানুষের প্রবৃত্তিগত ব্যাপার!” সবিনয়ে তাদের বলি, আমি তা মনে করি না। কেন? সেই কথাই পাড়ি ধীরেসুস্থে।
বড় হওয়ার দরকার কেন? সেটা কি বেশি ভোগের স্পৃহা থেকে উদ্ভূত? যদি তা হয়, সেই ভোগস্পৃহা কি স্বাভাবিক না আরোপিত? বড় হওয়ার প্রচলিত অর্থ অনুযায়ী সকল মানুষের কি বড় হওয়া সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তবে তার সুফল কারা ভোগ করে?
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে মানুষের উপরে মানুষের শোষণ বলবৎ থাকে। ফলে সমাজটা হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শত্রুতায় পূর্ণ। এ ধরণের সমাজে স্রেফ গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যও সংখ্যাগুরু মানুষকে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়। আর সংখ্যালঘু বিত্তবান অংশ সুখ-সাচ্ছন্দে জীবন অতিবাহিত করে। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে আরেক ধরণের লোক থাকে যারা ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’। তারা প্রচুর বিত্তশালী না, আবার হতদরিদ্রও না। এরা বিত্তবান সমাজের চুঁইয়ে পড়া উচ্ছিষ্টের সুফল ভোগ করে এবং শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ওই শ্রেণীভুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। চেষ্টা করে ‘বড়লোক’ হওয়ার। এই চেষ্টাটাকে তারা বলে ‘জীবনসংগ্রাম’, ‘স্ট্রাগল্’। এই স্ট্রাগলেরই অভীষ্ট হলো ‘বড় হওয়া’, যা কেউ কেউ হয়, অধিকাংশই হয় না। বড় হতে পারলে এক ধরণের সামাজিক মর্যাদা পাওয়া যায়, সেটা সমাজে এক ধরণের নিরাপত্তা। অধিকতর সুখ-সাচ্ছন্দে থাকা যায়। মোট কথা, ভোগের মাত্রা বহুগুণ বাড়ানো যায়। এখনকার প্রশ্নটি হলো এই অতিভোগের ইচ্ছা ‘কতখানি খাঁটি, আর কতখানি জল মেশানো’?
পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভোগের চ্যাপ্টারটা খুললেই দেখা যাবে লেখা আছে, “ভোগ একটি মানসিক ধারণা।” অর্থাৎ, সত্যিকার জৈবিক প্রয়োজন না থাকলেও মানুষ ভোগ করে। ভোগের পিছনে কিছু উদ্দীপনা কাজ করে। খেয়াল করে দেখবেন, সাবান, জুতো, টেলিভিশন, চিপস্, ক্রাকার্স ইত্যাদি জিনিসের কোম্পানিগুলো মাঝে মাঝে বিশেষ অফার দেয়। হালে সবচেয়ে বেশি অফার দেয় মোবাইল ফোন অপারেটররা। সব অফারের মূলকথা হলো অল্প টাকায় পণ্যটির বেশি একক কেনার সুযোগ। এটা একধরণের উদ্দীপক বা স্টিমুলি। এই স্টিমুলি দিয়ে মানুষের ভোগের আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে তোলা হয়। এই রকম অসংখ্য স্টিমুলি ব্যাবসাদাররা মানুষের উপর প্রয়োগ করে। কারণ, তাদের বেশি বেশি মাল বেচা দরকার। সমাজের মাতব্বর যখন ব্যবসাদাররা, তখন সেই সমাজের মূল উদ্দেশ্যই থাকে মাল বেচা ও পকেট ভরা। তাই, সেই সমাজের তাবৎ সংস্কৃতিক উপাদানও এই বেচাবিক্রির প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করে চলে। যা হাটে তোলা যায় না, তা এ সমাজে অচল। তাই, বড় হওয়ার ধারণাটিকে তারা শ্রেণী-নির্বিশেষে ছড়িয়ে দিতে চায়। কারণ, বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলে অনিবার্যভাবে ভোগের আকাঙ্ক্ষা বাড়বে। আর ভোগের আকাঙ্ক্ষা বাড়লে বেচাবিক্রি বাড়বে। বেচাবিক্রি বাড়লে অর্থাগম বেশি হবে।
গোটা ব্যাপারটা মোটেও এরকম সরল নয়। এটি একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ। পুরো প্রক্রিয়াটি ধরে রাখতে একটি বিরাট সমন্বিত কাঠামো গড়ে উঠেছে। একদিকে আছে শিক্ষা-ব্যবস্থা। যার দ্বারা এই ভোগের চক্র বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে টিকে থাকে। শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে ‘বড় হওয়ার’ ‘সুমহৎ’ আকাঙ্ক্ষাকে আরো জোরদার করে তোলা হয়। আরেকদিকে রয়েছে গণমাধ্যম, যা কিনা সাধারণের ভিতরে ভোগের ইচ্ছা উস্কে দেয়ার কাজটি জারি রাখে। তারা আমাদের শেখায়, মা সারাজীবন গরমে কষ্ট পেয়েছেন। মাতৃভক্ত সন্তান তাই অমুক কোম্পানির ফ্রিজ কিনে নৌকায় করে যাচ্ছে মায়ের কাছে। অতএব, অমুক কোম্পানির ফ্রিজ না হলে মায়ের মুখে হাসি ফুটবে না। তারা আরো শেখায়, অমুক ব্রান্ডের শিশুখাদ্য না খেলে আপনার সন্তান বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে বড় হবে। গরীব বাবার কালো-কুচ্ছিত মেয়ের বিয়ে হয় তমুক ব্রান্ডের ফেয়ারনেস ক্রিমের কল্যাণে। অমুক চিপস্ নাকি ‘দরজা বন্ধ করে একা একা’ খেতে হয়। তমুক বডি স্প্রে মাখলে পরকীয়ায় নাকি খুব সুবিধা হয়। আরো আরো বহু উদাহরণ দেয়া যাবে ইচ্ছে করলে। এমনকি, এসব কোম্পানির মুখে দেশপ্রেমের বুলিও আজকাল আমাদের শুনতে হয়। অর্থাৎ, মানুষের সকল ধরণের আবেগই এদের মাল বিক্রির হাতিয়ার এখন। আর এই অধিকতর মাল কিনতে পারার ক্ষমতা অর্জন করারই আরেক নাম বড় হওয়া।
‘বড় হওয়া’ শব্দবন্ধটির একরকমের ভ্রান্তি বা ইল্যুশন থাকে। আরো বেশি ইল্যুশন ও থ্রিল আছে স্ট্রাগল বা জীবনসংগ্রাম শব্দটার মধ্যে। আর ‘বড় হওয়ার জন্য স্ট্রাগল করা’ এই শব্দগুচ্ছটি যে মাত্রার ইল্যুশন তৈরি করে তা তুলনাহীন। এতক্ষণ যে মাল বেচাবিক্রির নগ্ন স্বার্থের কথা বলালাম তার গোটাটাকেই ব্যক্তিমানসে একটা মহত্বের চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া চলে কেবল এই শব্দগুচ্ছ দিয়ে।
এইখানে থেমে আবার একটু পিছনে ফেরা দরকার। ধরুন, একটি ছেলে। বাপ নেই, বড় সংসার। বড় ভাইটি অল্প উপার্জন করে। ছেলেটি পড়াশুনা করছে। তাকে বড় হতে হবে। পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে হবে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে বড় হওয়ার। এবার তার ঘর থেকে বেরিয়ে ওইরকম আরেকটি ঘরে ঢুকুন। দেখবেন একই চিত্র। বাংলাদেশের, সারাবিশ্বের, লাখ লাখ, কোটি কোটি পরিবারের একই দৃশ্য। সবাই বড় হতে চাইছে। বড় কিন্তু খুব অল্প লোকেই হবে। কেননা সবাই বড় হয়ে গেলে কারোরই আর বড় হওয়ার দরকার থাকবে না। বড় হওয়ার দরকার আছে, কেননা একদলের অঢেল আছে, আরেক দলের কিচ্ছু নেই গতর ছাড়া। একদল গতর খাটিয়ে খায়, আরেকদল গতর পুষে চলে। এই ভেদ দুনিয়াতে আছে বলেই মানুষের বড় হওয়ার দরকার পড়ে। ব্যক্তির কাছে এই বড় হওয়া দরকারি হতে পারে, কিন্তু মহৎ নয় আদৌ। এমনকি, দৃষ্টিটা আমরা যতই প্রসারিত করব, ততই বড় হওয়ার ধারণাটির অসারত্ব ধরা পড়বে। ততই, আমারা বুঝতে পারব ‘বড় হওয়ার স্ট্রাগল’টা আসলে একটা জুয়াখেলা। এবং চূড়ান্তরকমের অমানবিক জুয়া। এ যেন সেই গাধার নাকের সামনে ঝুলানো মুলোর মত (খুবই পুরোনো কিন্তু সবচেয়ে সঠিক উপমা)। এই বড় হওয়ার প্রক্রিয়া সমাজে চালু থাকলে কারবারী লোকের নানানরকম সুবিধা। বেচাবিক্রির কথাটা আগেই বলেছি, তারও চেয়ে বড় একটি সুবিধা আছে। সংখ্যাগুরু মানুষ এবং বিশেষ করে যারা তাদের মধ্যে আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ পেয়েছে, তারা এই জুয়াখেলায় মত্ত থাকে। এই জুয়ার নেশা তাদের ভুলিয়ে দেয়, মানুষের দুর্দশার মূল কারণ ও তার সমাধানসূত্র ব্যক্তিপর্যায়ের ব্যাপার না। মূল গলৎটি সমাজের অর্থনীতির কেন্দ্রে। ব্যবস্থাটি না বদলালে এই হারাজেতার খেলাই চলতে থাকবে, বহুতর মানুষের ভাগ্যের কোনো উন্নতি ঘটবে না।
এই বোধহীনতা এই সমাজ টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় অস্ত্রগুলোর একটি। তাই এই সমাজে ‘বড় হওয়ার সংগ্রাম’ খুবই মহৎ আর মানবমুক্তির সংগ্রাম খুবই ‘বিপজ্জনক’।
এইবারে আবার গোড়ার কথাটায় যাই। প্রহসনটি হলো, ‘বড় হওয়া’ আর ‘মানুষ হওয়া’ একই সাথে সম্ভব কিনা। মানুষ হওয়ার অর্থ যদি সৎ, নির্ভীক, সত্যবাদী, মানবপ্রেমী, পরিবেশ সচেতন ইত্যাদি মানবিক গুণসম্পন্ন হওয়া বোঝায় তবে বড় হওয়া তার আর হয়ে ওঠে না। কেউ তর্কের খাতিরে বলতে পারেন, “আহা! ওসব বাদ দাও। ‘বড় হওয়া’ বলতে তো ‘বড় মানুষ হওয়া’ও বোঝানো যেতে পারে।” এইবার আসলে অট্টহাসির সময়। ঠিকঠাক মানুষ হতে পারলে আবার আলাদা করে বড় মানুষ হওয়ার কী প্রয়োজন, সেটাই আরেকটা রহস্য!