রেন্টু ভাই

আজ সকাল থেকে একটা লোকের মুখ থেকে থেকে মনে পড়ছে। নামজাদা কেউ নয়। তিনি একজন কবি ছিলেন। এই শহরের এক ঘিঞ্জি এলাকার তস্য গলিতে তাঁর জীবন কেটেছে। হতচ্ছাড়া স্মৃতি আজ তাকেই কেন খুঁড়ে বের করলো কে জানে! আসলে তাঁর লেখা কবিতার একটা লাইন ঝট করে চলে আসল মাথার মধ্যে। তারপর স্মৃতির ম্যাগনেটিক টেপ সাঁই সাঁই করে রিওয়াইন্ড করে একটা জায়গা থেকে আবার চলতে শুরু করল। সালটা ২০০৭। আমি তখন বইমেলার সাথে সদ্য যুক্ত হয়েছি। সাত, আট, নয় তিনটে বছর ফেব্রুয়ারি এলে বইমেলাই ধ্যানজ্ঞান। অনেকের কথাই মনে পড়ে, সক্কলের কথা আপাতত মুলতুবি থাক, অন্যত্র বলা যাবে। রাত বারোটার আগে বাড়ি ফেরা হতো না একদিনও। সারাদিন মেলায় অর্ধভুক্ত-অভুক্ত থেকে খাটাখাটনি আর গেলাস গেলাস চা। আর দিনভর পেটভরে আড্ডা দিয়ে একপেট এসিড নিয়ে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরা। সেই ফেরার কয়েকজন সঙ্গী ছিল। কবি মশিরুজ্জামান, বন্ধু সুলতান মাহমুদ রতন, বন্ধু রাসেল মাহমুদ, শ্রাবণ ভাই আর রেন্টু ভাই— মীর আব্দুল জব্বার রেন্টু। এরা আর সকলেই কবি গোত্রের, আমিই একমাত্র অকবি। এদের সকলেই সবদিন থাকতেন না। আমি, মশিরুজ্জামান আর রেন্টু ভাই প্রতিদিনই একসাথে ফেরা হতো। মধ্যরাতে কখনো ফেরার পথে আরো একদফা আড্ডা হতো। মশিরুজ্জামানকে বাড়ি পৌঁছে দিতে আমরা বাকি দুজন হেঁটে যেতাম তাঁর সাথে, আবার আমাদের এগিয়ে দেয়ার ছুতোয় তিনিও ফের উল্টোদিকে হাঁটতেন। তখনই এই রেন্টু ভাইর সাথে অন্তরঙ্গতা বাড়তে থাকে। সারাদিনের কবি মানুষটির ভিতর থেকে আরো একটি মানুষ বেরিয়ে আসত তখন। তার সংসার আছে, সন্তান আছে, সে সংসারে চূড়ান্ত অনটন আছে— মানুষটি ধীরে ধীরে একেবারে নিজের মানুষ হয়ে গেল কখন, ঠিক ঠাহর করতে পারি নি। সেই মধ্যরাতে তাঁর দীর্ঘশ্বাস কানে ধরা পড়তো। নিজেরই একটা কবিতার লাইন বারবার করে বলতেন— আমি পড়ে আছি খুউব দক্ষিণে একা। সেই মানুষটি, সেই কাছের মানুষটি হঠাৎ একদিন দুম করে ট্রেনের মধ্যে হার্ট এটাকে মরে পড়ে থাকল। আর এমনই অধম আমি, সে দিনটিও আজ স্মরণ করতে পারি না। কিন্তু আজ সকালে, কবিতার এই লাইনটি মনে পড়ে, তারে সাথে তাঁর মুখটি মনে পড়ে থেকে থেকে চোখ ছলছল করে উঠছে। একটি পান খাওয়া বকবকে আড্ডাবাজ মুখ মনের মধ্যে জীবন্ত হয়ে উঠছে। কিছু ছেঁড়াখোঁড়া মানুষ, সহজ কিন্তু প্রাণবন্ত তারা আমার আজকের দিনের দৈন্যকে আরো প্রকট করে তুলছে। চারপাশে তাকালে আজ বুঝতে পারি একটি একটি করে মানুষ তাদের জীবনের পসরা গুটিয়ে নিচ্ছে। আমি ক্রমশ এই দক্ষিণে আরো একা হয়ে পড়ছি। যাহোক এই কবি আব্দুল জব্বার রেন্টু, আমাদের রেন্টু ভাই, তাকে কবি বলে খুব একটা মান্যিগণ্যি কোনোদিন করিনি, কিন্তু তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, সুজন ছিলে, আমাকে ভালবাসতেন। যে কবিতাটির জন্য আজ সারাদিন আমার এ দুর্ভোগ, সেটি তুলে দিলাম। বন্ধু রতনকে ধন্যবাদ কবিতাটির ছবি তুলে পাঠানোর জন্য (আবারও ভাবি, কী নির্দয় অকৃতজ্ঞ আমি! তাঁর একখানি বই ভালবেসে দিয়েছিলেন আমাকে, হারিয়ে ফেলেছি।)

আমি প’ড়ে আছি খুউব দক্ষিণে একা
কোথাও কোনো শব্দ নেই,
অথচ কোত্থেকে একঝাঁক বরফ হঠাৎ উড়ে এসে
জুড়ে বসে—
হয়ে যায় লৌকিক নিসর্গ নান্দিক কবিতা।

যেমন সলোমান তাঁর সম্রাজ্ঞী শেবাসহ
দরবার সিংহাসন কুরছি নিয়ে উড়ে যান
উড়ুক্কু যানে,
তেমনি আমার ভেতরে ডোরবেলে কে যেন চাপ দেয়-
কে ডাকে এই মধ্যযামে?
শরতে সাঁইজির স্পষ্ট আন্ধার ফুঁড়ে
ছুটে যায় দ্রুত মনোরেল নগর বিহঙ্গমা;
শুধু আমি পড়ে আছি খুউব দক্ষিণে একা
নগরের উল্টোপথে আঠারোবেঁকির চর হতে
ধবধবে-শাদা-বক শব্দগুলো ডিগবাজি খেয়ে নেমে আসে
কবিতার সমগ্র জলজমিনে,
এই শরতে বাইজির শাদা-শাদা রূপারাতে

হে শরৎনারী, এই অন্ধকার রাতে
তোমার পীনোন্নত ব্রা এবং নিতম্ব ছুঁয়ে ছুঁয়ে
ভেসে যাচ্ছে কোথায় নিজল শাদা মেঘ প্রেম—
কোন সে ডেরায় পরকীয়া সোহেলীর পথে?
আর আমি শুধু পড়ে আছি খুউব দক্ষিণে একা
একা।