আমি এক যক্ষ মহানগরীর...

আজকে আড্ডায় বসে হঠাৎ এক স্মৃতিকাতরতায় পেয়ে বসল। প্রসঙ্গ ভূপেন হাজারিকার গান। মনে পড়ে গেল এক স্পিকারের প্যানাসনিক ক্যাসেট। সে কবেকার কথা! প্রথম কৈশোরের শেষভাগ। সমস্তদিন ফাঁকে ফাঁকে ভূপেন হাজারিকার গান। ‘মানুষ মানুষের জন্যে’। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বারবার শোনা। জাপানি টিডিকে ক্যাসেটে যত্নে রেকর্ড করা সব গান। একটা রেকর্ডিং-এর দোকান ছিল, প্রথমে নিউমার্কেটে, অনেক পরে বায়তুন-নূর মসজিদের তলায়। শালা দুলাভাই মিলে চালাত সেই দোকান। দুলাভাই লোকটির নাম ছিল মোদাচ্ছের। আমরা তাঁকে বলতাম বাংলা গানের মাস্টার। যেমন বিশাল তাঁর সংগ্রহ, তেমনি অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি। হাজার হাজার গানের সুরকার, গীতিকার ও শিল্পীর নাম ছিল তাঁর নখদর্পনে। গান শোনার নেশায় পেয়েছিল অল্প বয়সেই। গোঁফের রেখা দেখা দেবার আগে থেকেই, অতি কষ্টে জমানো মূদ্রা কয়টি পকেটে নিয়ে, সাইকেল চেপে যেতাম গান তুলতে। নানারকম গানের দিকে আগ্রহ দেখে মোদচ্ছের কাকা আমাকে খুবই ভালবাসতেন। প্রতি ক্যাসেটে পাঁচ টাকা ছাড় ছিল আমার জন্য। ৬০মিনিটের একটা জাপানি টিডিকের দাম ছিল ৪৫ টাকা। আর রেকর্ডিং ফি ২০ টাকা। কাকা সব মিলিয়ে ৬০ টাকা রাখতেন। তাও সবসময় পকেটে থাকত না। কখনো ৫-১০ টাকা বাকি রেখে আসতাম। তা আবার তিনি ইচ্ছে করেই ভুলে যেতেন। যদি জিগ্যেস করতাম, “কাকা, আগের কয়ডা টাকা পাতেন না আমার কাছে?” তিনি থুতনির একগোছা দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে মনে করার ভঙ্গিতে বলতেন,”তা তো মনে হয় পাতাম কাকা, কিন্তু কয়টাকা মনে-টনে নেই। যাক, তুমি তার চেয়ে আমারে এট্টা নেভি সিগারেট খাওয়ায়ে দাও, তালিই হবেনে।” বলে অতিরহস্যময় স্নেমিশ্রিত একটা হাসি দিতেন। সেই লোকটা, এক প্রকার বাড়ির পাশের লোকটা দুম করে একদিন মরে গেল, আমি খোঁজও রাখিনি। হঠাৎ হঠাৎ সেই শীর্ণদেহি বৃদ্ধকে মনে পড়ে ঝপ করে চোখে জল চলে আসে।

যা হোক, বলছিলাম ভূপেনের গানের কথা। সেই কিশোর মনে গানগুলো এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল, যাকে বলে একেবারে ‘রিড অনলি মেমরি’ হয়ে গেছে। চোখ ছল ছল করে, বেহুলা বাংলা, গঙ্গা আমার মা, বিস্তীর্ণ দুপাড়ে, সাগর সঙ্গমে, আমি এক যাযাবর, শীতের শিশিরে ভেজা, দোলা, একখানা মেঘ ভেসে এলো আকাশে– এরকম আরো কত কত গান। ওহ হো, তারপর ওই গানগুলো! জীবন খুঁজে পাবি, ধমধমাধম ধমধমাধম জীবন মাদল বাজে, শারদীয় শিশিরে– আহা কী সব গান। ইচ্ছে করে একেকটা গান নিয়ে আলাদা করে বলি। আমার তাতে ক্লান্তি হবে না একটুও, কিন্তু এই ছোট লেখাটি যারা দয়া করে পড়ছেন, তাদের ধৈর্য্যের বিরাট পরীক্ষা হয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি অতএব, দুটো গানের কথা বিশেষ করে বলতে চাই। একটা হলো আমি- আমি এক যাযাবর। বুঝতে শেখার আগে থেকেই এই গানটা কেন যেন আমায় টানত। পরে বুঝেছি এই গানটার মধ্যে একরকমের আন্তর্জাতিকতা আছে। শুনলেই এক যাযাবর বিশ্বনাগরিকের ছবি ভেসে ওঠে মনে। সকল দেশের সকল মানুষের সাথে একধরণের আত্মীয়তা অনুভব করি মনে মনে। লিরিকটা খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, এ গানটা একেবারেই অন্য জাতের। “আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমারে আপন করেছে, ছেড়েছি সুখের ঘর॥” প্রথমেই দেশ-জাতির গণ্ডি ভাঙার ঘোষণা। তারপর সেই অদ্ভূত লাইনগুলো–
আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভোলগার মুখ দেখেছি
আমি অটোয়ার থেকে অস্ট্রিয়া হয়ে প্যারিসের ধূলো মেখেছি
আমি ইলোরার থেকে রঙ নিয়ে দূরে শিকাগো শহরে দিয়েছি
আমি গালিবের শের তাশখন্দের মিনারে বসে শুনেছি
আমি মার্কটোয়েনের সমাধিতে বসে বর্গীর কথা বলেছি…

শুনতে শুনতে মনটা দেহের খাঁচা ছেড়ে সেসব অচিন জায়গার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। তার পরের লাইনগুলোতেই ফুটে ওঠে আরেক চিত্র। শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনার।
বহু যাযাবর লক্ষ্যবিহীন, আমার রয়েছে পণ
রঙের খনি যেখানে দেখেছি রাঙিয়ে নিয়েছি মন
আমি দেখেছি অনের গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি
তার ছায়াতেই দেখেছি অনেক গৃহহীন নরনারী
আমি দেখেছি অনেক গোলাপ-বকুল ফুটে আছে থরে থরে
আবার, দেখেছি না-ফোটা ফুলের কলিরা ঝরে গেছে অনাদরে
প্রেমহীন ভালবাসা দেশে দেশে ভেঙেছে সুখের ঘর…

সেই অল্প বয়সে পৃথিবীব্যাপী বৈষম্যের এই সহজ চিত্র মনে কীরকম দাগ কেটেছিল তা বুঝতেই পারছেন। সেই ঘোর থেকে আজো বেরোতে পারিনি।

আরেকটা গানের কথা বলি। এ গানটা ভাললাগার তালিকায় যুক্ত হয়েছে অনেক পরে এসে। যখনকার কথা এতক্ষণ বলেছি তখনি নয়। এ গানটা একটা রোমান্টিক গান। একখান মেঘ ভেসে এল আকাশে। গোড়াতে এ গান আমার একদম ভাল লাগত না। (তখন অবশ্য কোনো রোমান্টিক গানই ভাল্লাগতো না। মাথায় একধরণের এন্টি-রোমান্টিসিজম ভর করেছিল।) এই গানের দুটি লাইন আছে, যে কারণে বড় হবার পরে গানটি মনে গেঁথে গেছে। লাইন দুটি হলো-
আমি এক যক্ষ মহানগরীর
যারে ডাকি কেন তার পাই না সাড়া..

তা, ছোটবেলায় কালিদাসস্য মেঘদূতম্ তো আর পড়ে পারিনি! বিরহী যক্ষের মর্ম কী করে বুঝব! সে বোঝার বয়সও তখন হয় নি। তার উপর সে যক্ষ যদি হয় নাগরিক যক্ষ, বাপরে বাপ! ফারুখ ভাই দারুণ বলেছেন। “যক্ষ কী বস্তু যদি না জানো, তবে ওই হাহাকার কী করে বুঝবে!” যা হোক, এ গান, বলা ভাল এই দুটি লাইন যতবার যতবার শুনি ততবার ততবারই বুকের মধ্যে যে তীব্র হাহাকার তৈরি হয় তা বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নেই। আজো আনন্দ-বিষাদে নাগরিক একাকিত্বে এই দুটি লাইন বারংবার ঘুরেফিরে মনে আসে–
আমি এক যক্ষ মহানগরীর
যারে ডাকি কেন তার পাই না সাড়া
চোখে তাই ঝরঝর বৃষ্টিধারা….