আকাদেমি সমাচার

/images/কাক্কেশ্বর.pngদুপুরবেলা চাট্টি খাওয়ার পরে পোষ মাসে বেশ একটু শীত-শীত করে। লেপের মধ্যে হাত-পা সেঁধিয়ে বেশ একটু মটকা মেরে পড়ে থাকতে নেহাত মন্দ লাগে না। আজকে দুপুরেও সেই আয়োজনই হচ্ছিল। খাওয়াটাও হয়েছে বেড়ে! পুঁই শাকের মিচলির চচ্চড়ি, মৌরলার ঝোল আর আমরুলি শাকের তোফা একটা অম্বল দিয়ে চাট্টি গরম ভাত খেয়ে যেই না লেপ মুড়ি দেবার উদ্‌যোগ কচ্ছি, এমন সময়, কে যেন ভাঙা-ভাঙা ভারী মোটা গলায় ডেকে উঠল, “কাআআআ!”

কী আপদ! এই মটকা মারার সময়ে আবার এমন বিচ্ছিরি আওয়াজ করে কে! তাকিয়ে দেখি, উঠোনে কাপড় নাড়া যে তারটি রয়েছে, তার উপরে বসে আছে স্বয়ং কাক্কেশ্বর। শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে। দেখে লাফিয়ে উঠলাম। সেই কবেকার কথা! আট বছর বয়সে দেখা হয়েছিল কাক্কেশ্বরের সাথে। কী সব হিসেবটিসেব করার একটা ব্যাবসা খুলেছিল। তারপর, সেই যে কোর্ট চত্ত্বর থেকে পাখা ঝাপটে কোথায় চলে গেল, অ্যাদ্দিন পরে এই দেখা! তাও আমারই উঠোনে! বিশ্বাস হতে চাইছিলো না। ভাবলাম এবারও সেবারকার মত স্বপ্ন দেখছি না তো! চোখটোখ কচলে দেখলাম, না, ঠিকই আছে। কাক্কেশ্বরই। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বললাম, “আরে কাক্কেশ্বর যে!” বুড়ো হয়ে গেছে বেচারা। কুচকুচে উপাধিটা এখন আর তার নামের সাথে যায় না। উষ্কোখুষ্কো পালক, সেই চিক্কণ কৃষ্ণবর্ণ এখন আর নেই। বললাম, “কোত্থেকে অ্যাদ্দিন পরে? কী করছো-টরছো কী আজকাল? তোমার সেই হিসেবের ব্যাবসা আছে এখনো?”

কাক্কেশ্বর বলল, “কী যে বলো! এখন হলো কম্পিউটারের যুগ, ডিজিটাল যুগ। আমার হিসেব কী এখন চলে! সে ব্যাবসা লাটে উঠেছে বহুদিন আগে।”

একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে চোখ মটকে ফিসফিস করে আমাকে বললো, “একটা নতুন ব্যাবসা খুলেছি!” আমিও অতি আগ্রহে জিগ্যেস করলাম, “কী ব্যাবসা?!!” কাক্কেশ্বর তখন একতাড়া কাগজের মধ্য থেকে একটা কাগজ আমার হাতে দিল। দেখলাম একটা হ্যান্ডবিল। কম্পিউটার কম্পোজ করে ফটোকপি করা। ঘষা ঘষা লেখা, পড়তে একটু কষ্ট হয়। দেখলাম,তাতে লেখা রয়েছে–

শ্রীশ্রীভূশণ্ডিকাগায় নমঃ
শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্‌কুচে
৪১নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটি

বাংলা একাডেমী অনুমোদিত

১ নং দিশি লঘুকৃত রেক্টিফায়েট স্পিরিট বা বংলা মদ

হে সূরামোদী বঙ্গবাসী, তামাম বঙ্গাল মুলুকে আমরাই বাংলা মদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য পরিবেশক। একশতভাগ খাঁটি রেক্টিফায়েড স্পিরিটের সাথে শতভাগ শুদ্ধ পাতিত জল বা ডিস্টিলড্ ওয়াটার মিশিয়ে এই মদ প্রস্তুত করা হয়। আপনার ঠিকানা আমাদের লিখে পাঠালে বা ইমেইল করলে বা এসএমএস করলে আমরা বোতল পার্শেল করে থাকি। মূল্য প্রতি লিটার ২৫০ টাকা, পার্শেল ফি ১০০ টাকা। নেশা না হলে মূল্য ফেরত।

সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!

আমরা সনাতন বায়সবংশীয় দাঁড়িকুলীন, অর্থাৎ দাঁড়কাক। আজকাল নানাশ্রেণীর পাতিকাক, হেঁড়েকাক, রামকাক প্রভৃতি নীচশ্রেণীর কাকেরাও অর্থলোভে নানারূপ ভেজাল মদের ব্যবসা চালাচ্ছে। সাবধান! তাদের মেথিলেটেড স্পিরিট মিশ্রিত মদ খেয়ে অক্কা পাবেন না!

***
মনে রাখবেন, আমরাই বাংলা একাডেমী স্বীকৃতি একমাত্র বাংলা মদ পরিবেশক।



আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! “কাক্কেশ্বর! কী লিখেছ এসব! বাংলা একাডেমির কাজ তো শুনেছি ভাষাটাষা, বইপত্তর নিয়ে। তারা আবার মদের লাইসেন্স দেয়া শুরু করলো কবে থেকে? আশ্চর্য!”

শুনে কাক্কেশ্বর “তাও জানো না!” বলে সেই লাল হুলো বেড়ালটার মত বিশ্রীরকমে ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ হাসতে লাগলো। আমি বললাম, “না জানি না। হেয়ালি না করে ভেঙে বলো তো দেখি ব্যাপারখানা।”

কাক্কেশ্বর এক চোখ বুজে কী যেন খানিক ভাবলো। তারপর বলল, “শোনো”। বলেই আবার দু চোখ বুজে বসে রইলো। তারপর, চোখ দুটো খুলে গোল গোল চোখে হড়বড় করে বলতে শুরু করলো, “এদিকে হয়েছে কী, শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন ভাই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার ফরম তুলতে গিয়ে শোনে তাকে ফরম দেবে না! কী কাণ্ড! কেন দেবে না!? মহাপরিচালক মুখ খিচিয়ে বলল, ‘কেন রে শালা! এখন কেন! তখন তো আমাদের পোঙায় খুব কাঠি দিয়েছিলি। তখন মনে ছিল না? যা ভাগ! দু-বছরের মধ্যে যেন এ তল্লাটে আর না দেখি!’ রবিন ভাইও শাসিয়ে এলো, ‘দেখব শালা তুমিও কেম্নে মেলা করো। আমি কাউন্টার মেলা ডাকব! হুঁ!’ মহাপরিচালক চোখমুখ লাল করে বলল, ‘যা যা ফকড়েমি করিসনে! তোদের মত দু পয়সার প্রকাশক আমি ‘টুট’ দিয়েও গুণি না!’ পরদিন হৈ হৈ রৈ রৈ মার মার কাট কাট! মিছিল-সমাবেশ-সেপাই-পল্টন-লাঠি-কাঁদানে গ্যাস, একেবারে ধুন্ধুমার কাণ্ড! প্রকাশকরা সব বেঁকে বসল, বাংলা একাডেমী বারান্দায়ও আর কেউ যায় না। অগত্যা বাংলা একাডেমী বলল, ‘বইপত্তরের কাজই বন্ধ। এখন থেকে আমরা বাংলা মদের লাইসেন্স দেব।’ আমি খবর পেয়েই কাগেয়াপটি থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে একটা লাইসেন্স নিয়ে নিলাম। শালারা মোটা টাকা খেয়েছে জানো! সব জায়গায় জোচ্চুরি! ব্যাস্! এই হলো আমার নতুন ব্যাবসার গল্প! লাগবে নাকি তোমার? তোমার জন্য কনসেশন আছে।”

আমি ভাবছি, এইবেলা কাক্কেশ্বরকে দু লিটারের অর্ডার দেব। খাটের তলায় লুকিয়ে রেখে সন্ধেবেলাটায় বেশ কদিন একটু মৌতাত হবে! বাংলা একাডেমী অনুমোদিত বাংলা বলে কথা! এমন সময়! কে যেন পিছন থেকে ঝুঁটি ধরে টানতে লাগল। শুনলাম মায়ের গলা, “এই ভর সন্ধেবেলায় কেমন ঘুমুচ্ছে দেখ! এমন আটকুঁড়ে ঊনপাঁজুরে ছেলে আমি জম্মে দেখিনি বাপু! কোনো কাজেকম্মে নেই, কেবল পড়ে পড়ে ঘুমোনো! হাড়মাস জ্বালিয়ে খেলো একেবারে! ওঠ হতচ্ছাড়া! ওঠ বলছি!”

বুকের মধ্যে তখন বেজে চলেছে–

“আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
কারোর দানে পাওয়া নয়….”