মুজিকার আত্মকথন

হোসে আলবার্তো 'পেপে' মুজিকা কর্ডানো[হোসে মুজিকা। উরুগুয়ের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। তাঁকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বিনম্র রাষ্ট্রপ্রধান। আবার একটা গোষ্ঠী তাঁকে বিশ্বের দরিদ্রতম রাষ্ট্রপ্রধানও বলে। ষাটের দশকে তিনি টুপামারো গেরিলা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। অনেক পরে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। মুজিকা প্রকৃতিঘনিষ্ঠ সরল জীবনযাপনের পক্ষে। সাম্য ও সমতার পক্ষে। এই লেখাটি মূলত ‘হিউম্যান দ্যা মুভি’ নামক একটা প্রামাণ্যচিত্রে মুজিকার কিছু বক্তব্যের অনুলিখন। তিনি খুব সহজ ভাষায় তাঁর জীবনদর্শনটি বলে গেছেন এখানে।]

আমি হোসে মুজিকা। জীবনের শুরুর দিনগুলোতে আমি মাঠে কাজ করেছি কৃষক হিসেবে, রুটিরুজির জন্য। তারপর আমি নিজেকে উৎসর্গ করেছি দিনবদলের সংগ্রামে, আমার সমাজের মানুষের জীবন উন্নত করার জন্য। আজ আমি রাষ্ট্রপতি। এবং আগামিকাল, আর সকলের মতই পোকার স্তুপে পরিণত হবো এবং অদৃশ্য হয়ে যাবো।

আমার জীবনে অনেক প্রতিবন্ধ ছিল, অনেক আঘাত; কিছু বছর কাটিয়েছি জেলে। সে যা হোক… যারা দুনিয়াটা বদলাতে চায়, এগুলো তাদের স্বাভাবিক জীবনচক্রের অংশ। আশ্চর্য হলো, আমি এখনো টিকে আছি এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমি জীবন ভালবাসি। আমি চাই আমার জীবনের শেষ যাত্রাটি এমন হোক, যেন একটা লোক, যে কিনা কোনো পানশালায় গিয়ে সাকীকে (পানীয় পরিবেশক) বলছে, “এই দফা হোক আমার উদ্দেশ্যে।”

আমি এরকম বেয়াড়া, কারণ আমার মূল্যবোধ ও জীবনচর্চা সমাজের সেইসব মানুষের প্রতিফলন যাদের সাথে থাকতে আমি সম্মান বোধ করি– এবং আমি তাদের সাথেই থাকি। রাষ্ট্রপতি হওয়াটা কোনো বড় কথা না। আমি এ নিয়ে অনেক ভেবেছি। জীবনে আমি প্রায় দশ বছর একলা কাটিয়েছি, একটা গর্তের মধ্যে। চিন্তা করার অনেকটা সময়.. সাতটা বছর কাটিয়েছি কোনো বইপত্র ছাড়া। ফলে, আমি চিন্তা করার সময় পেয়েছি। আমি ভেবে ভেবে যা বের করেছি তার সারকথা হলো- হয় তুমি সমস্ত অহেতুক বোঁচকা-গাট্টি থেকে মুক্ত হয়ে খুব অল্পে সন্তুষ্ট হবে, কারণ তোমার সুখ তোমার মাথার মধ্যে; নয়তো তুমি কোথাও সন্তুষ্টি পাবে না। আমি দারিদ্র্যের সাফাই গাইছি না, ভব্যতার পক্ষে বলছি। যবে থেকে আমরা একটি ভোগবাদী সমাজ উদ্ভাবন করেছি, তবে থেকে অর্থনীতিটা আকারে বাড়ছে। দুঃখের বিষয় হলো, এর গুণগত বৃদ্ধিটা হচ্ছে না। আমরা আজগুবি সব চাহিদার বিরাট এক পর্বত আবিষ্কার করেছি– দৈনিক নতুন নতুন জিনিস কেনো আর পুরোনোগুলো ফেলে দাও… এটা স্রেফ আমাদের জীবনের অপচয়! আমি যখন একটা কিছু কিনি বা তুমি যখন একটা কিছু কেনো, তখন কেবল টাকা দিয়েই তুমি তার দাম শোধ করো না, শোধ করো জীবন দিয়ে। কেননা, ওই টাকাটা তোমাকে জীবন ক্ষয় করেই আয় করতে হয়। একটা পার্থক্য বোঝা দরকার, জীবন হলো সেই জিনিস, যা টাকা হলেই কেনা যায় না। এটা কেবলই ছোট হতে থাকে। কারো জীবন ও স্বাধীনতা এইভাবে খরচা করে ফেলা খুবই দুঃখের ব্যাপার।

উরুগুয়ে একটা ছোট্ট দেশ। রাষ্ট্রপতির একটা আলাদা বিমান পর্যন্ত আমাদের নেই। আসলে, তাতে আমাদের থোড়াই কেয়ার। ফ্রান্স থেকে আমরা একটা খুবই দামি হেলিকপ্টার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সার্জিকাল সুযোগসুবিধাসম্পন্ন একটা উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার; প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবা দেয়ার জন্য। রাষ্ট্রপতির বিমানের পরিবর্তে আমরা একটা উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার কিনতে চাই যেটাকে মধ্য-উরুগুয়েতে নিয়োগ করা হবে দুর্ঘটনায় পতিত মানুষদের উদ্ধার করার জন্য এবং জরুরী চিকিৎসাসেবা দেবার জন্য। এটা খুবই সোজা ব্যাপার। তোমার কি এ নিয়ে দ্বিধা আছে? রাষ্ট্রপতির বিমান বনাম উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার। বিষয়গুলো এরকমই। আমার যেটা মনে হয়, ভব্যতার বিষয়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি বলছি না যে আমাদের সেই গুহাবাসীদের যুগে ফেরত যেতে হবে বা খড়ের ঘরে বসবাস করা লাগবে, একদমই তা বলছি না। ভাবনাটা মোটেও সেরকম না। যেটা আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমাদের অবশ্যই অদরকারি জিনিসে, ধরো বিরাট এক বিলাসবহুল বাড়ি যা দেখাশোনা করতে ছয়জন চাকরবাকর লাগে, সে সবে সম্পদ অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কী হবে এসবে? কী হবে! এগুলোর কিছুই খুব দরকারি না। আমরা অনেক সহজভাবে বাঁচতে পারি। আমরা আমাদের সম্পদ সেই সবে ব্যবহার করতে পারি যা সবার দরকার। এটাই হলো গণতন্ত্রের আসল মানে, যে মানেটা রাজনীতিকরা হারিয়ে ফেলেছেন। কারণ, রাজীনীতির মানে যদি হয় রাজমুকুট, সামন্তযুগের জমিদারের মত, কর্তা যখন শিকারে যাবেন, চারপাশে ভাঁড়ের দল তখন বাঁশি বাজাবে– ভাবনাটা যদি এমনই হয়, তাহলে এত বিদ্রোহ-বিপ্লবের কী দরকার ছিল? থাকতাম পড়ে আমরা সেই আগেকার যুগে! সমতার নাম করে তারপরে এইসব রাষ্ট্রপতির বিলাসবহুল প্রাসাদ ইত্যাদি, এগুলো ওই রাজা-জমিদারগিরিরই নতুন চেহারা। জার্মানিতে তারা আমাকে ২৫টা বিএমডব্লিউ মটরসাইকেল দিয়ে এসকর্ট করে এক মার্সিডিস বেঞ্জে চড়িয়ে নিয়ে চলল, বর্মের বহরে সে গাড়ির দরজার ওজন তিন টন– কী মানে আছে এসবের? (হা হা হা এটা একটা গল্প মাত্র)। আমি একটা নরমসরম মানুষ, যা সামনে আসে নিতে পারি, মানিয়ে নিতে পারি, কিন্তু তবুও… আমি যেরকম ভাবি, আমাকে সেটা বলতেই হবে।

আদত সমস্যাটা সম্পদের না, সমস্যাটা রাজনীতির। সরকারগুলো পরের নির্বাচনে জেতা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কে মাতব্বর হবে তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমরা ক্ষমতার জন্য লড়াই করি… (নীরবতা) কিন্তু ভুলে যাই মানুষ আর পৃথিবীর সমস্যাগুলো। সমস্যাটা পরিবেশের না! সমস্যাটা রাজনীতির। আমরা সভ্যতার এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, এখন আমাদের একটা বিশ্বব্যাপী ঐক্য দরকার। আর আমরা সেটা থেকেই মুখ ফিরিয়ে আছি। আমাদের প্রদর্শনবাদ আমাদের অন্ধ করে ফেলেছে, প্রতিপত্তির পিপাসা আমাদের অন্ধ করে ফেলেছে, বিশেষ করে শক্তিমান দেশগুলোকে। তাদের অবশ্যই একটা উদাহরণ তৈরি করতে হবে। এটা খুবই লজ্জার যে কিয়োটো প্রোটোকলের ২৫ বছর পরেও আমরা কেবল তার প্রাথমিক মাপকাঠি নিয়েই ব্যস্ত আছি। এটা খুবই লজ্জার!

মানুষ হয়তো একমাত্র প্রাণী যারা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলতে সক্ষম। এই উভয়সংকটই এখন আমাদের সামনে। আমার কেবল একটাই আশা, আমি যেন ভুল হই।

মানুষের চরিত্র এমনভাবে তৈরি যে মানুষ আরাম-আয়েশের জীবনের চেয়ে দুর্দশার জীবন থেকেই ভাল শিক্ষা নিতে পারে। এর মানে এই না যে আমি একটা দুঃখদুর্দশার জীবন সন্ধান করা পরামর্শ দিচ্ছি, বা সেরকম কোনোকিছু, কিন্তু আমি মানুষকে যেটা বোঝাতে চাই: তুমি সবসময় আবার উঠে দাঁড়াতে পার। জীবন যে কোনো সময় আবার শূন্য থেকে শুরু হতে পারে। একবার, কিম্বা হাজারবার, যতদিন তুমি বেঁচে থাকবে। সেটাই জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। অন্যকথায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি হারতে পারো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি তোমার লড়াই ছেড়ে দিচ্ছ। তুমি লড়াই ছাড়ছো মানে তুমি তোমার স্বপ্নও ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছ। লড়াই, স্বপ্ন, পড়ে যাওয়া, বাস্তবতাকে মোকাবেলা করা– এটাই আমাদের অস্তিত্বকে, যে জীবন আমরা যাপন করি তাকে অর্থবহ করে তোলে। সারাক্ষণ অতীত ক্ষতের তোয়াজ করে জীবন চলতে পারে না। একই বৃত্তে ঘুরে ঘুরে জীবন চলতে পারে না। জীবনে যে দুঃখ পেয়েছি, তা কোনোদিনই সবটুকু উপশম হবে না। সেটা কেউ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। তোমাকে শিখতে হবে নিজের দুঃখ-ক্ষত পোঁটলা বেঁধে সামনে এগিয়ে যেতে হয় কীভাবে। আমি যদি সারাটা সময় নিজের ক্ষত নিয়ে আহা-উহুই করতে থাকি, তাহলে তো আমার আর এগোনো হবে না। আমি জীবনটাকে দেখি একটা রাস্তার মতন, যেমন করে সেটা সামনে পড়ে আছে, তেমনই। কেবল আগামিকালটাই আসল কথা। আমাকে সবাই বলে, সাবধান করে, একটা পুরোনো প্রবাদ ব’লে– ‘তুমি নিশ্চয়ই অতীতকে মনে রাখবে, নয়তো তুমি একই ভুল বারবার করবে।’ আরে ভাই, আমি মানুষকে জানি! মানুষ হলো সেই প্রাণী, যা একই পাথরে চৌদ্দবার ঠোক্কর খায়। প্রত্যেক প্রজন্ম তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখে, মোটেই তারা আগেকার প্রজন্মের অভিজ্ঞতার কাছে ফেরত যায় না। আমি মানবতাকে কোনো একটা আদর্শের ছাঁচে ফেলতে নারাজ। একজন আরেকজনের অভিজ্ঞতা থেকে কীইবা শিখতে পারে? আমরা প্রত্যেকে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই, আমরা তা থেকেই শিখি।

(হেসে) এই হলো জীবন নিয়ে আমার ভাবনা। আমি কোনোরকম কোনো প্রতিশোধ চাই না।