মুরহিলে ও চাঁদ মুলুকের ষাঁড়

একটি আফ্রিকান রূপকথার রূপান্তর

অনেক কাল আগে, আফ্রিকা দেশে মুরহিলে নামে এক ছেলে ছিল। মুরহিলের মা মনে করতো ছেলেটা একেবারে অকম্মার ঢেঁকি। সারাক্ষণ তাকে গালমন্দ করতেই থাকতো। সে যা করতো, কিছুই তার মায়ের মনে ধরত না, একটা কিছু খুঁত ধরাই চাই।

নিত্যি-নিত্যি এই অপমানে তিতিবিরক্ত হয়ে মুরহিলে তার বাপের একটা বসবার টুল চেয়ে নিল। এই টুলটা ছিল তাদের বংশের চৌদ্দ পুরুষের পুরোনো একটা জাদুর টুল। সেই টুলের উপরে বসে যতরকমের মন্তর-তন্তর তার জানা ছিল, সব আওড়াতে লাগলো। হঠাৎ টুলটা মাটি ছেড়ে উপরে উঠে গেল। আর সাঁ সাঁ করে ছুটে চললো চাঁদের দিকে।

চাঁদ মুলুকে নেমে মুরহিলে প্রথমেই লোকজনকে জিগ্যেস করলো, “তুমাগে সদ্দারের বাড়িডা কোনদিকি কও দিনি?” চাঁদ মুলুকের লোকজন বলল, “তা তোমারে বলবো কেন? আমাদের সর্দারের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে তোমার কী কাজ?” মুরহিলে বললো, “দাদা গো, দিদি গো, মাসি গো, মেসো গো, আমি বৈদেশী লোক। কিছুই তো চিনি না, তুমরা যা কবা আমি করে দেব। তুমরা খালি সদ্দারের বাড়ির ঠিকানাডা কও।” চাঁদ মুলুকের লোকেরা তখন তার কাছে পৃথিবীর খবরাখবর জানতে চাইলো। মুরহিলে যা জানে সব বললো। যা জানে না তাও সব বলে দিল বানিয়ে বানিয়ে। চাঁদ মুলুকের লোকেরা তার মুখে নিত্যনতুন আশ্চর্য সব খবর শুনে বেজায় খুশি হলো। বলে দিল সর্দারের বাড়ির হদিশ।

সর্দারের গাঁয়ে পৌঁছে তো মুরহিলে অবাক! এরা তো এখনো সেই আদিম যুগে পড়ে আছে! আগুন জ্বালাতে জানে না, মাংস খায় কাঁচা, বাসনপত্তর কিছুই নেই, রাতে ঠাণ্ডায় কাঁপে ঠক-ঠক করে!

মুরহিলে কাঠে কাঠ ঘষে আগুন জ্বালালো। তাজ্জব ব্যাপার! এমন কাণ্ড চাঁদ মুলুকের লোক কখনো দেখেনি। সর্দারের তো চক্ষু ছানাবড়া। এমন লোককে তো হাতছাড়া করা চলে না! মুরহিলে সর্দার আর চাঁদমুলুকের তাবৎ লোকের খুব প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলো। চাঁদ মুলুকের সর্বকালের সবচেয়ে বড় জাদুকর বলে লোকে তার জয়ধ্বনি করতে লাগলো।

তার এই আশ্চর্য কাজের জন্য চাঁদের দেশের মানুষেরা তাকে অনেককিছু উপহার দিল। উপহার বলতে, সে দেশের রেওয়াজ হলো গুণীজনদের অনেকগুলো গরু-বাছুর আর অনেকগুলো বৌ উপহার দেয়া। কিন্তু, মুরহিলে এমন কাজ করেছে, যা চাঁদের দেশের ইতিহাসে কেউ কখনো করেনি। তাই, সর্দারের একার পক্ষে তাকে উপযুক্ত উপহার দিয়ে পোষালো না। গ্রামের সব লোক, মানে মেয়ের বাপেরা এলো মুরহিলেকে তাদের জামাই করতে। অনেকগুলো বউ আর অনেকগুলো গরু-বাছুর পেয়ে সে রাতারাতি বিরাট বড়লোক হয়ে গেল!

চাঁদ মুলুকে বেশ কিছুদিন সুখে কাটিয়ে মুরহিলে এবার দেশে ফেরার আয়োজন করলো। মনে তার বিরাট গর্ব: এবার মা দেখবে, তার ছেলে কীরকম একটা কেউকেটা লোক হয়েছে!

সেজন্যে সে তার বন্ধু তোতাপাখিকে দেশে পাঠাল তার যাত্রার আগাম সুখবর প্রচার করার জন্য। এদিকে হয়েছে কী, মুরহিলে তো দেশে নেই অনেকদিন। তার পরিবার ভেবেছে অকম্মা ছেলেটা বুঝি মরে-হেজে গেছে চাঁদে গিয়ে। সে যে বেঁচে আছে তা তার পরিবারের কেউই বিশ্বাস করতে চায় না।

মুরহিলেকে গিয়ে তোতা যখন এই সংবাদ দিল, মরহিলে বললো, “তুই ব্যাটা বড় মিথ্যুক তোতা! তুই আসলে যাসইনি আমার বাপ-মায়ের কাছে। এদিক-ওদিক উড়ে ঘুরেফিরে এসে এখন ফালতো খবর দিচ্ছিস!” তোতা বলল, “বটে! আমি মিথ্যুক! দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোকে!” বলেই তোতা আবার পাখা ঝাপটে চলে গেলে। পৃথিবী থেকে লাঠি হাতে মুরহিলের থুত্থুরে বুড়ো বাপকে ধরে আনলো। এবার বাপেরও বিশ্বাস হলো ছেলে বেঁচে আছে, আর ছেলেও বাপকে দেখে বেজায় খুশি। এবারে মুরহিলে নিশ্চিন্ত মনে পাঁজি দেখে পৃথিবীতে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করলো।

সে কী জমকালো আয়োজন! তার পাঁচ কুড়ি বউ আর সোয়া শ’খানেক ছেলেপুলেদের ভাল ভাল জামাকাপড় পরিয়ে হীরে-জহরত দিয়ে সাজালো। আরো সাথে যাবে হাজার হাজার গরু-বাছুর। বিরাট কাফেলা! মনে মনে ভাবলো, “এবারে মা নিশ্চয়ই তাজ্জব বনে যাবে!” কিন্তু, মুশকিল হলো, এত লোকজন আর এত এত গরুবাছুর তো জাদুর টুলে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না! কী করা যায়? শেষমেশ তারা পায়ে হেঁটেই পৃথিবীর পথে রওনা দিলো।

কিন্তু চাঁদ কি আর পৃথিবী থেকে এট্টুসখানি দূরে! সে যে অনেক দূর! মুরহিলে খানিক পথ গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলো। তার পা আর চলে না।

তার সাথে আসা চাঁদ মুলুকের বেশ তাগড়া এক ষাঁড় তখন তাকে গিয়ে বললো, “বাপু, তুমি আমার আমার মনিব, তোমার এ কষ্ট তো আমার আর সহ্য হয় না। আমি জাদু জানি। সেই জাদুতে তোমাদের সক্কলকে দুনিয়াতে নিয়ে যেতে পারি। তবে হ্যাঁ, কথা দিতে হবে, আমাকে তুমি খাবে না।”

মুরহিলে তাকে কথা দিল, তাকে কখনো মেরে ফেলবে না, কখনো খাবে না। খুশি হয়েই কথা দিল। এমন জাদুর বলদ কার বাথানে আছে আর! ষাঁড় তখন আশ্চর্য জাদুবলে মুরহিলেকে দলবলসমেত পৃথিবীতে পৌঁছে দিল।

মুরহিলেকে ফিরে পেয়ে পরিবারের লোকেরা আনন্দে শিউরে উঠলো, তাদের চোখ ঠিকরে গেল মুরহিলে আর তার নতুন সংসারের জাঁকজমক দেখে।

এমনকি তার যে মা তাকে উঠতে-বসতে তুচ্ছজ্ঞান করতো, সেই মায়ের তো এখন আহ্লাদ আর অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। তার যেমন স্বভাব! সে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলের গুণকীর্তন শুরু করলো।

মুরহিলে তার বাপ-মা আর বাড়ির সকলকে ডেকে বলল, “দেখ, এই বলদের জন্য আমি আজ বাড়ি ফিরতে পেরেছি। খবরদার, একে কখনো মারবে না।” সবাই তাতে একবাক্যে রাজি।

দিন পেরিয়ে মাস গেল, মাস পেরিয়ে বছর গেল। ষাঁড়টাকে না মারার জন্য যে প্রতিজ্ঞা তারা করেছিল, তা সবাই গেল ভুলে। তাছাড়া, হাজার হাজার গরু-বাছুরের মধ্যে কোনটা কোন ষাঁড়, তা কী ছাই কারো মনে আছে নাকি!

একদিন তাই, মুরহিলের বাপ-মা সেই ষাঁড়টাকেই মেরে ফেললো খাওয়ার জন্য। মুরহিলের মা তেল-মসলা দিয়ে বেশ কষে রান্না করলো সেই ষাঁড়ের মাংস।

সেদিন সন্ধেবেলা, মুরহিলে বসেছে খেতে। মাংসের টুকরো তাকে দেখে কথা বলে উঠলো, “মুরহিলে! তুমি কথা রাখলে না! মেরে ফেললে আমাকে!” মুরহিলে পাত্তা দিল না। যেই না মুরহিলে মাংসের টুকরোটা মুখে পুরেছে, ওমনি স্বয়ং পৃথিবী তাকে কপ করে গিলে ফেললো, কবর দিয়ে দিলো মাটির তলার চির-অন্ধকারে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: গল্পটির বাঙলা ভাষায় এই রূপান্তরিত সংস্করণের সর্বসত্ব লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ছাপা বা অন্য মাধ্যমে এটি ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ রইলো।