ঘাটকোল, মায়াচেলা ও অন্যান্য

দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির জল পড়লেই তারা মাথা তুলে দাঁড়ায়। তিনকোনা চকচকে পাতা নিয়ে। কিছুদিন যেতে না যেতেই সব সোমত্থ লকলকে ডাঁটা। মাথায় সেই তিনকোনা চকচকে পাতা। কেউ বলে ঘাটকুল, কেউ বলে ঘাটকোল। কচুবংশীয় এ শাকটি আমার আশৈশবের প্রিয় বস্তু। মূলত ভর্তা খেতে হয়। চিংড়ির সাথেই জমে ভালো। কারো কারো মতে এর নানাবিধ ঔষধি গুণাগুণ আছে। যেমন, ঘাটকোল ভর্তা খেলে নাকি গায়ের ব্যথা-বিষ সেরে যায় (আপসোস! মনেরটা সারে না)। আমার গায়ে তেমন বিষব্যথা কোনোকালেই হয় নি, তাই সেটা পরখ করে দেখার সুযোগ ঘটে নি। তবে খেতে যে অমৃততুল্য (এবং অপরাপর কচুজাতীয়দের মত এরও যে কিছু পুষ্টিগুণ আছে) তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য, ঝাঁঝটা যাদের সহ্য হয় না এবং যাদের অহেতুক ‘কচুভীতি’ আছে যারা খাদ্যাখাদ্য বিষয়ে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘জাজমেন্টাল’, তারা হয়তো ভিন্ন কথা বলবেন। কিন্তু যে কোনো সংস্কারবর্জিত সুরসিক রসনাবিলাসী আমার সাথে একমত হবেন, সে কথা হলপ করে বলতে পারি। মাইকেল বাংলাভাষা নিয়ে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য আক্ষেপ করে বলেছিলেন‒ কেলিনু শৈবালে ভুলি কমল কানন। কথাটা বাংলার বনে-বাদাড়ে বেড়ে ওঠা অজস্র প্রকারের শাকলতার ক্ষেত্রেও খাটে। ‘আঁচল ভরিয়া’ কত যে মণিরত্ন সে ‘ধরিয়া’ রেখেছে, তার ‘রূপখনি’ সম্পূর্ণ আবিষ্কার করা এ অর্বাচীনের কর্ম নয়। আপসোসের বিষয় হলো, যে মা-মাসি-পিসি-খুড়ী শ্রেণী এ বিষয়ে সম্যক জ্ঞান রাখতেন, যাদের পূণ্যস্পর্শে এইসকল বুনো পত্র-পুষ্প-লতা-স্কন্দ বেহেশ্‌তি চিজে পরিণত হতো, সেই শ্রেণীটি ক্রমশ বিলুপ্ত হতে চলেছে। আমি যেন তাই মধুকবির মত স্বপ্নাদেশ পাই‒ ওরে বৎস, শোন, মাতৃকোষ রতনের রাজি ইত্যাদি; এবং দত্তকূলোদ্ভব কবির মতই সেই আদেশ মাথা পেতে নিয়ে বলি‒ মধুহীন কোরো না গো তব মনকোকনদে।

পুনশ্চঃ কেবল ঘাটকোল দিয়ে আজকের রসনাপর্ব সমাপ্ত করলে কচু জাতির প্রতি আমার সাতিশয় পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পায়। কেননা আজকের অন্য পদটিও ঘাটকোলের চেয়ে কিছু অংশে কম যান না। মৌরলা, এ অঞ্চলে যার নাম মায়াচেলা সেটি রসিকজন মাত্রই এক নামে চেনেন। স্বচ্ছশরীরিণী এ মাছটি স্বাদে এবং গুণে অতুলনীয় বলা চলে। আজকে সক্কাল বেলা উঠে গেছিলাম বাজারে। বোশেখ মাস। মাছের আকাল। সারা বজারময় কুৎসিত তেলাপিয়া কিলবিল করছে। তারই মধ্যে একটা থালিতে রূপোর মত চকচকে এ মাছ কয়টার দিকে আমার চোখ আপরাধীর সন্ধানে থাকা ঘুষখোর পুলিশের চোখের মত আটকে গেল। সাইজেও সচরাচর যেমন মায়াচেলা পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশ বড়। আমার মায়ের ভাষায় ‘চলা চলা’। সেই চলা চলা মায়াচেলা উপযুক্ত মূল্যে খরিদ করে বাড়ি চলে আসলাম। আগের দিন রাতে ডাঁটা শাক কিনেছিলাম, জাত ও লক্ষণ বিচারে তা সুমিষ্ট হওয়ার কথা (হয়েছেও তাই)। সেই ডাঁটা দিয়ে এই চলা চলা চেলা মাছের একটা লম্বা ঝোল হলে কেমন হবে তা ভাবতে গিয়েই আমি কিশোর বয়সের প্রেমের মত পুলকিত হয়ে উঠছিলাম। অবশেষে ঠিক দুপ্পরবেলা (যখন ভূতে মারে ঢেলা) সেই বহু প্রতীক্ষিত অতুল রসদ আস্বাদনের সুযোগ ঘটল। কী বলব মশাই! আমার মাকে একটা নোবেল দেয়া উচিৎ এ হেন উদর-শান্তি বিধান করার জন্য। মুখে দিয়েই মনে মনে প্রিয় একটি ঋক উচ্চারণ করলাম‒ মধুবাতা ঋতায়তে ইত্যাদি (এ ঋকে আলো, বাতাস, নদী, গাছ, ঊষা, সন্ধ্যা সবকিছু মধুময় হওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ পেলেও মাছের কোনো উল্লেখ নেই। তখনকার আর্যরা বোধহয় মাছ খেতে জানত না)।